ইতিহাসের পাতা থেকে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ

প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০১৭, ১৩:১৮

ফরহাদ আকন্দ

উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন শহর ঘাঘট নদীর তীরবর্তী এই গাইবান্ধা জেলা শহর। বন্যা বিপর্যস্ত ও ক্রমাগত অবহেলার শিকার হয়েও গাইবান্ধা জেলার শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষার মান বরাবরই আশাব্যঞ্জক। 

বিশেষ করে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ। ঘাঘটের স্রোতের মতো গাইবান্ধার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেমন এগিয়ে চলেছে বহু বছর থেকে, ঠিক তেমনই শিক্ষাকে জীবন প্রদীপ জ্ঞান করে শিক্ষার আন্দোলনও হয়েছে এখানে অর্ধশতাব্দীকাল পূর্ব থেকেই। অর্ধশতাব্দী পূর্বকালের এতদাঞ্চলের শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষা ব্রতীজনের সাধনার ফসল এই গাইবান্ধা সরকারি কলেজ।

সীমাহীন সমস্যার আর্বতে নিপতিত হয়েও, পর্বত প্রমাণ প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে আজও এ কলেজটি মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে শিক্ষা সংগ্রামের স্মারক ভাস্কর্যের মতো। ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট গাইবান্ধা সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তখন চলছিল উত্থানুপতনের পালা। এমনই এক সময়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অস্বিনী কুমার চৌধুরী ৭ জন শিক্ষক ও ২৩ জন ছাত্র নিয়ে বর্তমান গাইবান্ধা ইসলামিয়া বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণীর কেবল মানবিক শাখা দিয়ে কলেজটিকে দাঁড় করিয়েছিলেন। 

শিক্ষা যাত্রা শুরুর পর কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফণিভূষণ রায়। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়টা ছিল গাইবান্ধা সরকারি কলেজের জন্য উল্লেখযোগ্য সময়। এ সময়ই স্নাতক (পাস) কোর্স চালু হয় শিক্ষানুরাগী স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও কলেজ প্রশাসনের যৌথ প্রচেষ্টায়। প্রবাদপ্রতিম অধ্যক্ষ এন.সি. সেন ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্পিকার শাহ্ আব্দুর হামিদ এর যৌথ প্রচেষ্টায় গাইবান্ধা সরকারি কলেজে সহশিক্ষার স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হয় এই পঞ্চাশের দশকেই। একই শ্রেণি কক্ষে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের পাঠ গ্রহণের এক সাহসী তথা মহৎ উদ্যোগ এতদাঞ্চলে নারীশিক্ষার আন্দোলনকে দারুণভাবে বেগবান করেছিল। শিক্ষাকার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনার পাশাপাশি সমাজপ্রেম বা দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও রয়েছে গাইবান্ধা সরকারি কলেজের। 

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং সেন্টার। অমিত সাহসী কমান্ডার আজিম নিয়মিত গেরিলা প্রশিক্ষণ দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের এই কলেজ প্রাঙ্গনেই। আর কমান্ডার আজিমকে প্রত্যক্ষ সহযোগীতা দান করতেন সেই রক্তাক্ত সময়ের সাহসী অধ্যক্ষ অহিদ উদ্দিন আহম্মদ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশ মুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই কলেজ শিক্ষক পরিষদের এক আলোচনা সভায় পাকহানাদার বাহিনীর রোমহর্ষক, বিভীষিকাময় নির্যাতনের করুন চিত্র যখন তুলে ধরছিলেন অধ্যক্ষ অহিদ উদ্দিন আহম্মদ, ঠিক তখনই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সবাইকে নিস্তব্ধ করে দিয়ে। অনুমান করা হয় পাকহানাদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনের চিত্র তার মনে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল এবং তিনি তা সইতে না পেরে আলোচনার টেবিলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে দেশের ভগ্ন ও বিপর্যস্ত অর্থনীতির কারণে কলেজটি তার সীমিত সম্পদ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে। তবে অর্থনিতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া এই জনপদের কলেজটির শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়নি কখনও। যুগের চাহিদা মেটাতে এবং শিক্ষা বিস্তারের যৌক্তিক প্রয়োজনে ১৯৮০ সালে ১ মার্চ কলেজটি জাতীয়কৃত হয়। এ সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে এ কলেজের দায়িত্ব পালন করেন গিয়াস উদ্দিন। 

এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর গোলাম উদ্দিন আহম্মেদ। সে সময় চেষ্টা করা হয়েছিল বাংলা ও সাহিত্যে অর্নাস কোর্স প্রবর্তনের। কিছু ছাত্র ভর্তি করার পর পাঠদান কার্যক্রমও শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা আর বেশি দূর এগোতে পারেনি। 

অতঃপর ১৯৯৬ এর শেষভাগ। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে পদোন্নতি পেয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে এই কলেজে এলেন প্রফেসর মো: আব্দুল হামিদ। কলেজের ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার তুলনায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নিতান্ত কম দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লেন তিনি। 

অত্যন্ত অল্পকালের মধ্যে ‘কলেজটি বাঁচাতে হবে’ নীতি গ্রহণ করে এ নীতি আওতায় কলেজে অর্নাস কোর্স প্রবর্তনের লক্ষ্যে নিরলস ভাবে কাজ করতে থাকলেন তিনি। এ সময় কলেজের সমস্ত শিক্ষক ঘরসংসার ফেলে এসে ছুটলেন অর্থের খোঁজে, কেউ সময় দিলেন কাঠমিস্ত্রীর পাশে, কেউ সময় দিলেন গ্রন্থাগারের গ্রন্থতালিকা তৈরীতে, কেউ ছুটলেন স্থানীয় বিদ্যানুরাগী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে পরামর্শের জন্য। 

কিন্তু শিক্ষার চাকা কি এতোটাই সচল যে, রাতারাতি অনার্স কোর্স প্রবর্তিত হবে এ কলেজে? অথচ বিস্ময়করভাবে হয়েছে তাই। মাত্র তিন মাসের যৌথ প্রয়াস অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অর্নাস কোর্স প্রবর্তিত হয়েছে এ কলেজের দশটি বিষয়ে। এ ব্যাপারে ছাত্র ছাত্রীদেরও ছিল অসমান্য অবদান। ছাত্র ছাত্রীরা যৌথভাবে ছাত্র সংসদের সমস্ত অর্থদান করেছিল অর্নাস কোর্স প্রবর্তনের জন্য। আর কলেজের সমস্ত শিক্ষক দিয়েছিলেন একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ। কর্মচারীরাও করেছিলেন অক্লান্ত পরিশ্রম এ ব্যাপারে। অর্নাস কোর্স প্রবর্তিত হলে প্রথম বছরেই নির্ধারিত আসন পূর্ণ হয় ৪৫০ জন ছাত্র ছাত্রী দিয়ে। বহু কাঙ্খিত মর্যাদার আসনে আসীন হয় গাইবান্ধা সরকারি কলেজ। 

উল্লেখ্য, ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষে কলেজটি জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ এবং অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: আব্দুল হামিদ জেলার শেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন। বর্তমানে ১২.১২ একর জমির ওপর কলেজটি অবস্থিত। মূল ভূখন্ডের ঠিক মাঝামাঝি কলেজের বিভিন্ন ভবন সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ব প্রান্তে আর পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে দুটি বিশাল আকৃতির পুকুর। কলেজের উত্তর প্রান্তে দীর্ঘ টিনশেড ভবনটি তার প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে এখনও বর্তমান। এই ভবনেই পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে দিবারাত্রি ক্লাশ পরিচালিত হত। 

এভবনেই অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কার্যালয়, সংশ্লিষ্ট অর্নাস বিষয়ের ৭টি দপ্তর ও সেসবের সেমিনার কক্ষ এবং পুরুষ মিলনায়তন রয়েছে। কলেজের মূল ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে প্রথমে হাতে বামে পড়বে ৫২-এর ভাষা আন্দোলেনের অমর স্মারক শহীদ মিনার। আর হাতের ডানে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে কলেজ মসজিদ। একটু এগোলেই হাতের ডানে পড়বে অন্য একটি টিনশেড ভবন। নারকেল গাছ, মেহগনি আর শিশুগাছ যেন যৌথভাবে ছায়ার স্নেহে আগলে রেখেছে ভবনটি। ওটি রসায়ন ভবন। এই ভবনেই রয়েছে স্নাতক বিজ্ঞান এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রীদের দুটি পৃথক লাইব্রেরি। 

স্থান সংকুলান না হওয়ায় গণিত বিভাগের অফিস কক্ষ ও গণিত সম্মান শ্রেণির সেমিনার কক্ষের ব্যবস্থা এখানেই করা হয়েছে। এই ভবনের সামনেই বিস্তৃত উদার সবুজ খেলার মাঠ। রসায়ন ভবন ছেড়ে হাতের ডানে পড়বে কলেজ ক্যান্টিন, বি.এন.সি.সি এর অফিস এবং সাইকেল গ্যারেজ। এই কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপকের অধীন বি.এন.সি.সি. এর সদস্যদের ও অপর একজন সহকারী অধ্যাপকের অধীন রেঞ্জারদের এবং একজন শরীর চর্চা শিক্ষকের অধীন রোভার্সদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। 

কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং অতিথিদের আপ্যায়নে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জেলা পর্যায়ে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের শরীর চর্চায় তারা উল্লেখযোগ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়ে কলেজের ভাবমূর্তি উজ্জল করেছে অনেকবার। কিছুদুর এগিয়ে হাতের ডানে পকুর সংলগ্ন পদার্থ বিজ্ঞান ভবনটি সহজেই চোখে পড়বে। একতলা ভবনে বিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। কলেজের মূল ক্যাম্পাস থেকে ভবনটি একটু দূরে এবং নিরিবিলি হওয়ায় সেখানে সবসময় পড়াশুনার চমৎকার পরিবেশ বিদ্যমান। 

কলেজের দ্বিতল বিশিষ্ট মূল ভবনটি উত্তরদিকে দাঁড়িয়ে আছে অবকাঠামোগত সমবৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে। ভবনেই রয়েছে শিক্ষক বিশ্রামাগার, ছাত্রী মিলনায়তন, সুবিশাল গ্রন্থাগার, বিস্তৃত পাঠ কক্ষ, উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ও প্রাণি বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি। রয়েছে দশটি শ্রেণি কক্ষ। দ্বিতল বিশিষ্ট এই ভবনের পূর্বপ্রান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কলেজের ছাত্র সংসদ ভবন। তারও পূর্ব পাশে অবস্থিত ছাত্রদের একতলা হোস্টেল। দূরদূরান্তের ছাত্রদের আবাসিক সংকট মোচনে এই হোস্টেলের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। 

কলেজ ক্যাম্পাসের পূর্বপ্রান্তের পুকুরে পাড়া ঘেঁষে দন্ডায়মান দ্বিতল বিশিষ্ট বিজ্ঞান ভবন। বিজ্ঞান ভবনে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিগুলো স্থান্তারিত না হলেও অর্থনীতি বিভাগ এবং হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অফিস এবং সেমিনারকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এর কক্ষগুলো। এভবনেরই ঠিক উত্তর পাশেই রয়েছে ত্রিতল বিশিষ্ট একাডেমিক ভবন। এই ভবনে রয়েছে বাংলা বিভাগ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, কম্পিউটার ল্যাব, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ইংরেজী বিভাগ, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ। 

আমাদের প্রত্যাশা অতি অল্প সময়ের মধ্যে সরকারি অনুদানের ভিত্তিতে এই কলেজের বহুতল বিশিষ্ট ভবন, ছাত্র ছাত্রীদের আধুনিক মানের হোস্টেল, বিভিন্ন বিষয়ে আধুনিক মানের ল্যাবরেটরি, আধুনিক মানের গ্রন্থাগার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন এই কলেজ তার পূর্ব ঐতিহ্য তথা সুনাম অনুযায়ী শিক্ষার পথ আরও প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে রাখবে অগ্রণী ভূমিকা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত