স্বাধীনতা পুরস্কারের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে নৃত্যগুরু বাদলের

প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:২৩

রাজশাহী ব্যুরো

জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান পেতে যাচ্ছেন নৃত্যগুরু বজলুর রহমান বাদল। ২০১৭ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য অন্যদের সাথে তিনিও মনোনীত হয়েছেন। সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাকে এই সম্মান দিতে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৩ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাধীনতা পুরস্কার দেবেন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সরকার ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি বছর এ পুরস্কার দিয়ে আসছে। স্বাধীনতা পদকের ক্ষেত্রে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ১৮ ক্যারেট মানের পঞ্চাশ গ্রাম স্বর্ণের পদক, পদকের একটি রেপ্লিকা, ৩ লাখ টাকা ও একটি সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়।

স্বাধীনতা পদকের জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসন নৃত্যগুরু বজলুর রহমানের নাম মনোয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠায়। বাদলের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আতাউল গণি বলেন, নৃত্যগুরু বাদলের স্বাধীনতা পুরস্কারে জেলা প্রশাসনও গৌরববোধ করছে।
ওস্তাদ বজলুর রহমান বাদল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার ওস্তাদ তার হাতে-পায়ে নাচের যে মুদ্রা তুলে দিয়েছিলেন, তা এখনো সচল। দীর্ঘজীবনে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন রাজা-মহারাজার দরবারে নৃত্য পরিবেশন করে পেয়েছেন বিপুল সম্মান। এখনো মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় সিক্ত তিনি। শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেয়েছেন নৃত্যগুরু উপাধি। এ বছর তিনি সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার রাতে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তির খবর পৌঁছালে বজলুর রহমান বাদল আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার জীবনের এটাই স্বপ্ন ছিল। আমার ভাগ্য যে আমি এ পুরস্কার পাচ্ছি।

শিল্পীজীবনের কথা বলতে বলতে গিয়ে বাদল হারিয়ে যান ৮০ বছর আগের স্মৃতিতে। বলেন, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। মালদহ জমিদারবাড়ির একজন লোক ডেকে বলল, ‘এই ছেলে নাচ শিখবে? আমি তোমাকে নাচ শেখাব।’ কথাটা মাকে এসে বললাম। তার কাছেই আমার নাচে হাতেখড়ি। এরপর কখন যে ঘুঙুরের মতো নাচের সঙ্গে জীবনকেই বেঁধে ফেলেছি, বুঝতে পারিনি।’

বজলুর রহমান ১৯২৩ সালের ১৮ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষরা কলকাতার মানুষ ছিলেন। দাদা আশাক হোসেন আমের ব্যবসা করতে এসে মালদহে বাড়ি করেছিলেন। সেখানেই তার জন্ম। বাবার নাম আবুল কাশেম। মায়ের নাম সখিনা বিবি। ১৯৪৫ সালে মালদহ জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। পরের বছর নাটক করতে রাজশাহী আসেন। আর ফেরা হয়নি। এখনো রাজশাহীতেই আছেন। সপ্তাহে দুদিন রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমিতে নাচের ক্লাস নেন। শহরের সব বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এখনো তার সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে।

এই দীর্ঘ জীবনে তিনি নাচ ছাড়া আর কিছুই করেননি। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। থাকেন রাজশাহী নগরের শিরোইল এলাকায় মেয়ের বাসায়। ধ্রুপদি নৃত্যের চারটি বিভাগেই বজলুর রহমানের দক্ষতা সমান। এ ছাড়া ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরি ও কত্থক নৃত্যেও রয়েছে তার অসামান্য দখল।

ওস্তাদ বজলুর রহমানের বসার ঘরে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন সংবর্ধনার ক্রেস্ট। ঢাকাসহ সারা দেশে তাকে ৭৪টি সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামানের দাদা সেই কবে তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, সে ছবিও রয়েছে তার কাছে। আগে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন রাজা-মহারাজার দরবারে নাচের আমন্ত্রণ পেতেন।

১৯৫১ সালে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার সঙ্গে নাচের মুদ্রা রপ্ত করে ফেলেন। তার বিদ্রোহী নৃত্যের জন্য ২০১১ সালে তিনি নজরুল একাডেমি পুরস্কার পান। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার পান।

বজলুর রহমানের ভাষায়, মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর তাকে ‘ইয়াং বয়’ বলে সম্বোধন করেন। দেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী নিপা, শিবলী, লায়লা হাসান, জিনাত বরকতুল্লাহসহ আরো অনেকের সঙ্গে রয়েছে তার সখ্যতা। নৃত্যশিল্পী রিংকু, ওলি ও সাকিবকে তিনি নিজ হাতে নৃত্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বলেও জানান প্রবীণ এ নৃত্যগুরু।

সারাজীবন মানুষকে মুগ্ধ করে গেলেও কথায় কথায় বলে ফেললেন তার কষ্টের কথা। তিনি বলেন, সব সময় তো অনুষ্ঠান হয় না। শিল্পীদের ডাকও পড়ে না। এমনও দিন গেছে, একটা রুটি এনে আচারের তেল দিয়ে পেঁয়াজ ভর্তা করে স্বামী-স্ত্রী খেয়ে রাত কাটিয়েছি।

এ গুণীজন আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে, বরেন্দ্র অ্যাকাডেমি (১৯৮৩), উত্তরা সাহিত্য মজলিস (১৯৮৩), রাজশাহী থিয়েটার (১৯৮৫), শাহজাদ পুর নাট্যসংঘ (১৯৯০), রাজশাহী বৈশাখী মেলা (১৪০১), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মন্নুজান হল (১৯৯৬), সঙ্গীত শিক্ষা ভবন (৫০ বছর পূর্তি, ১৯৯৭), রাজশাহী সিটি করপোরেশন (১৯৯৭), জয় বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট (১৯৯৭), জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মেলন (১৪০৪ বঙ্গাব্দ), ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন স্মৃতিপদক (১৯৯৮), রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ (২০০০). পাবনা থিয়েটার (২০০১), অবকাশ নাট্যদল (২০০১), ঢাকা নৃত্যাঞ্চল সম্মাননা (২০০২), তুলসী লাহিড়ী পদক (২০০২) এবং রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন স্বর্ণ পদক (২০০২)।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত