বাংলাগানের কিংবদন্তী শচীন দেব বর্মণ

প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০১৬, ১৩:২৩

সাহস ডেস্ক

বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় বাংলা গানের কিংবদন্তীতুল্য শিল্পী শচীন দেব বর্মণ। এস ডি বর্মণ হিসাবে তিনি বিশেষ পরিচিত। গত প্রায় একশত বছরেও বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে তার কালোত্তীর্ণ গানের আবেদন বিন্দুমাত্র কমেনি। কেবল সংগীতশিল্পী হিসাবে নয়, গীতিকার হিসাবেও তিনি ছিলেন সার্থক।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণের জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায়। ত্রিপুরার চন্দ্রবংশীয় মানিক্য রাজপরিবারের সন্তান তিনি। তৎকালীন ত্রিপুরার অন্তর্গত কুমিল্লার রাজপরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মা মণিপুরি রাজবংশের মেয়ে নিরুপমা দেবী। শচীনদেব বর্মনের পিতা নবদ্বীপ কুমার বর্মণ ছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের সৎ ভাই। বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের সৎ মা পটরানীর পুত্র তার পথের কাটা দূর করার জন্য নবদ্বীপ কুমার বর্মণকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। তখন শচীন দেব বর্মণের পিতা রাজবাড়ির কর্মকর্তা কৈলাস সিংহের পরামর্শে ১৮৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সপরিবারে এদেশে চলে আসে এবং কুমিল্লায় স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন সেই সঙ্গে সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দেন। রাজবাড়ীর এই কর্মকর্তা কৈলাস সিংহই ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ ‘রাজমালার’ রচয়িতা।

বীরচন্দ্র মাণিক্যের অর্থানুকূল্যে কুমিল্লার চর্থায় ৬০ একর জমি নিয়ে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন কুমার বাহাদুর নবদ্বীপ চন্দ্র। এই প্রাসাদে ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর তার ছোট সন্তান শচীন দেব বর্মণের জন্ম। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর মুম্বাইতে তিনি মারা যান।

শচীন দেব বর্মণ ১৯২০ সালে কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রাস (এসএসসি) পাশ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯২২ সালে ঐ কলেজ থেকেই আইএ (এইচএসসি) পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে বিএ পাস করেন। ১৯২৪ সালে এমএ ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তার বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেব বর্মন ছিলেন একজন সেতার বাদক এবং ধ্রুপদী সংগীতশিল্পী। তিনি শচীন দেব বর্মণের প্রথম সংগীত শিক্ষক। এরপর তার সংগীত শিক্ষা চলে ওস্তাদ বাদল খান এবং বিশ্বদেব চট্রোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে। ধ্রুপদী সংগীতের এই শিক্ষা তার মধ্যে সংগীতের মৌলিক জ্ঞান সঞ্চারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

কুমিল্লা থেকে শচীন দেব কলকাতা চলে আসেন ১৯২৫ সালে। ১৯২৩  সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে তিনি প্রথম গান করেন। ১৯৩১ সালে পিতা নবদ্বীপ চন্দ্র কলকাতায় দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীন দেব তখন থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। পিতার মৃত্যুর পর তিনি অগাধ জলে পড়ে গেলেন। এই অবস্থায় তিনি কুমিল্লায় গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে এবং রাজ্য সরকারের কোনো উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। তা না করে একা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সংগীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দিলেন। ত্রিপুরার প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আস্তানা বাধঁলেন।

১৯৩২ সালে ভারতের বিখ্যাত রেকর্ড প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠান এইচএমভিতে অডিশন দিলেন শচীন, কিন্তু তাতে সফল হতে পারলেন না। হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না তিনি। তাই একই বছর শচীনের প্রথম রেকর্ড বের হয় হিন্দুস্তান মিউজিক প্রোডাক্টস থেকে। তার রেকর্ডকৃত প্রথম দুটি গান হলো  ‘ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে’ ও ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়’। এ সময় তিনি পল্লীগীতি গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

‘রজনী’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে নাম লিখান শচীন। প্লেব্যাকের পাশাপাশি তিনি ১৩টি ছবিতে তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে হিন্দি ছবি ‘শিকারি’ তে প্রথম সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। তিনি নজরুলের কথা ও সুরে ৪টি গান রেকর্ড করেন। ১৯৩৪ সালে এলাহাবাদ অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে তাঁর অবস্থান আরও সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছে যায়।

এসডি বর্মন ১৯৩৮ সালে হাই কোর্টের জজ কমলনাথ দাশগুপ্তের দৌহিত্রী, গানের ছাত্রী মীরা ধর গুপ্তকে বিবাহ করেন। মীরাও ছিলেন সংগীতশিল্পী ও নামকরা গীতিকার। ১৯৩৯ সালে তাদের সন্তান রাহুলদেব বর্মণের জন্ম হয় (যিনি বর্তমানে আরডি বর্মন নামে বিখ্যাত)। তার পুত্রবধূ আশা ভোশলে সংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

১৯৪৪ সালে আবারো মুম্বাই থেকে ডাক এলে শচীন দেব অনেক ভেবে চিন্তে কলকাতা ছেড়ে সেখানে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবির জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার এবং ‘পিয়াসা’ ছবির জন্যে এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি হেলসিনি, ফিনল্যান্ড আন্তর্জাতিক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অন্যতম বিচারক ছিলেন। তিনি লাভ করেন ‘সন্তহরিদাস’ পুরস্কারসহ অগণিত আরো অনেক পুরস্কার।

শচীন দেবর উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে- ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে রে. . . ভ্রমরা  নিশিতে যাইও ফুলবনে, তুমি এসেছিলে পরশু কাল কেন আসনি, তবে কি তুমি আমায় বন্ধু কাল ভালোবাসিনী, শোন গো দখিন হাওয়া, বিরহ বড় ভালো লাগে, গানের কলি সুরের দুরিতে, ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা, বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে, কালসাপ দংশে আমায়, কে যাস রে ভাটি গাঙ্গ বাইয়া, কী করি আমি কী করি, না আমারে শশী চেয় না, নিটোল পায়ে রিণিক ঝিনিক, সুবল রে বল বল প্রভৃতি।

তাকডুম তাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল/ সব ভুলে যাই তবুও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল…’ ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেওয়া নতুন বাংলাদেশকে এভাবেই স্বাগত জানিয়েছিলেন শচীন দেব বর্মন তাঁর উৎসারিত মাতৃ বন্দনায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত