প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মোতাহের হোসেন চৌধুরী

‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম’

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:৫৩

১.
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন চর্চা যার কাছে অভিন্ন ছিল, সংস্কৃতির নিঃসঙ্গ সেই পথিকই মোতাহের হোসেন চৌধুরী। মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রবক্তা, মানবতাবাদী ও মননশীল প্রবন্ধকার তিনি। বিশুদ্ধ মননের সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াণ দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। শিক্ষক মোতাহের হোসেন চৌধুরী একদিন কলেজের অনুষ্ঠান শেষে বেশ রাত করে বাড়ি ফেরেন। রাতে বসল গানের আসর। নিজে অসুস্থ বোধ করায় শ্যালিকা জাহানারাকে (রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী জাহানারা ইসলাম) অনুরোধ করলেন তাঁর প্রিয় কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে। আসরের শেষ গানটি ছিল 'তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে'। এ গান শুনতে শুনতেই সীমার প্রাঙ্গণ ছেড়ে অসীমের অঙ্গনে চিরতরে চলে গেলেন। সে দিনটিই ছিল ১৯৫৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। বাঙালির চিৎপ্রকর্ষের উন্নতির জন্য আজ বাংলাদেশের প্রতিটি সচেতন মানুষের মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে পড়া জরুরি। একটি সভ্যজাতি কিভাবে বুদ্ধি, চিন্তা, প্রগতি, ব্যক্তিত্ব, মানবতা ও সৌন্দর্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠবে তা জানার জন্য মোতাহের হোসেন অবশ্যপাঠ্য।

২.
‘রুচিবান লোক দশের একজন নয়, দশ পেরিয়ে একাদশ।’ - মোতাহের হোসেন চৌধুরী
মোতাহের হোসেন চৌধুরী ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে গভীরভাবেই যুক্ত ছিলেন এবং 'শিখা' ছিল তাদের মননচর্চার আলোকিত মুখপত্র। তারা সবাই যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মকে বিচার ও শোধন করতে চেয়েছিলেন। তাদের চিন্তার গড়নে ছিল অধ্যয়নের স্পর্শ, প্রকাশের প্রধান মাধ্যম ছিল প্রবন্ধ আর বক্তব্যে ছিল তুলনামূলক যুক্তি, মানবতা ও বিচারবোধ। নিজস্ব ভাবনাকে মূল্য দিতে তারা উৎসুক ছিলেন; ব্যক্তির অধিকারবোধ প্রতিষ্ঠায় তারা ছিলেন তৎপর। নানাবিধ সংস্কারে আচ্ছন্ন বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রগতিশীল চিন্তাচর্চায় তাই 'শিখাগোষ্ঠী'র দারুণ অবদান রয়েছে। তাদের আন্দোলনের কথা ভাবলে আজও বিস্মিত হতে হয়। আর মোতাহের হোসেন চৌধুরীর আজীবন সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রেও রয়েছে সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির সাধনাকেই তিনি মনুষ্যত্বের সাধনা বলে মনে করেছেন, প্রবল আস্থাবান ছিলেন। সভ্যতা-সংস্কৃতি-সৌন্দর্যানুভূতি বিষয়ে তিনি মত ব্যক্ত করেছেন স্থির প্রত্যয়ে। তার প্রবন্ধ সঙ্কলনের নাম প্রবন্ধের সূচনাবাক্য 'ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম’ আমাদের মাঝে এক রকম প্রবচনের মর্যাদা লাভ করেছে।

৩.
'কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি।'- মোতাহের হোসেন চৌধুরী
মুক্তবুদ্ধিচর্চার প্রবক্তা, উদার মানবতাবাদী ও মননশীল প্রবন্ধকার হিসেবে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর বিশেষ খ্যাতি আছে। মননশীল প্রবন্ধ রচনা করে বাংলা সাহিত্যে যারা অতি অল্প সময়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী (জন্ম : ১৯০৩-প্রয়াণ : ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬) তাদের অন্যতম। বিস্মৃত ভাবুক মোতাহের হোসেন চৌধুরী বাংলার মুসলমানদের চিন্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। শব্দচয়ন ও বাক্যপ্রয়োগে তার সাহিত্যসম্ভার যেমন সুখপাঠ্য তেমনি বুদ্ধিদীপ্তও বটে। গভীরতম ভাবের সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশভঙ্গি মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে এক বিশিষ্ট আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। মানুষের মননশীল মেধাবিকাশে তিনি ছিলেন সত্যিকারের উপযাচক এবং গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া মূল্যবোধহীন সমাজচেতনার বিরুদ্ধে অকুতোভয় সৈনিক। তার মতে, ‘চূড়ার দিকে নজর রেখেই গোড়ার কথা ভাবা দরকার। নইলে গোড়াতেই আবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়- চূড়ায় ওঠা আর সম্ভব হয় না। মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের দিকে নজর রেখেই রাষ্ট্র গড়ে তোলা দরকার। নইলে শেষ পর্যন্ত তা মানুষের মুক্তির উপায় না হয়ে বন্ধনের রজ্জু হয়ে দাঁড়ায়।’

৪.
'নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো এ-ই কালচারের আদেশ।'- মোতাহের হোসেন চৌধুরী
মোতাহের হোসেন চৌধুরী বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের এক বিরল প্রতিভা। তার এ প্রতিভা শুদ্ধতা থেকে, সৌন্দর্য থেকে উৎসারিত। তার চিন্তা-চেতনা, মনন-মনীষা একটি ভূখন্ডে সভ্যতার নতুন বীজ বুনতে সক্ষম। তার চিন্তা- চেতনা-মনন ধারণ করে, লালন করে আমরা আমাদের সভ্যতায় এক নতুন যুগের সূচনা করতে পারি। তিনি এক বিরলপ্রজ লেখক লোকচক্ষুর অন্তরালে, লজ্জাতুর; অথচ প্রবল ব্যক্তিত্বশালী, মিতবাক অথচ এক অপার্থিব সুন্দর ও সত্যের সাধনায় নিমগ্ন: খ্যাতির অভিলাষ তার নেই; বিনয়ী, সজ্জন এবং সম্ভ্রান্ত মনের অধিকারসম্পন্ন হৃদয়বান পুরুষ তিনি, তিনি মোতাহের হোসেন চৌধুরী। তিনি রুচির ব্যাপারে ছিলেন অতি সূক্ষ্ম, আদর্শের জায়গায় ছিলেন আপসহীন। সাহিত্যের সকল বিষয়েই তার সূক্ষ্ম রুচির ছাপ পাওয়া যায়, কোথাও তার সামান্যতম স্খলন ঘটেনি। সাহিত্য সাধনায় অমনোযোগী তিনি কখনও হননি। তবু তার রচনার পরিমাণ বেশি নয়। এর একটি কারণ চিন্তায় ও রচনায় শিথিলতার প্রশ্রয় তিনি দিতে চাইতেন না। কিন্তু হয়তো তার চেয়েও বড় কারণ, যে সমাজে তার জন্ম হয়েছিল উদার-মানবিক চিন্তাধারার প্রতি সে সমাজের সুস্পষ্ট বিতৃষ্ণা। তিনি ভদ্র প্রকৃতির লোক ছিলেন, অপ্রিয় বাকবিতন্ডা যথাসম্ভব তিনি এড়াতেই চাইতেন। কিন্তু পরিমাণে অল্প হলেও তার রচনা যে বিশিষ্ট হয়েছে এতেই তার সাহিত্য-সাধনা সার্থক হয়েছে। সাধারণত সব দেশেরই প্রচলিত সাহিত্যে শিথিল চিন্তা, ভাববিলাসিতা এসবের স্থান অনেকখানি। কিন্তু সত্যিকার সাহিত্য এ সবের থেকে ভিন্নধরনের বস্তু, কেননা অকৃত্রিম দুঃখবেদনা ও আনন্দবোধ থেকেই তার উদ্ভব, ভাববিলাসিতা থেকে নয়। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর রচনা সত্যিকার সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। যে সমাজে ও কালে তার জন্ম তার অসম্পূর্ণতা অযৌক্তিকতা আর বিকৃতি সম্বন্ধে তার তীক্ষ্ম চেতনার স্বাক্ষর তাতে রয়েছে।

৫.
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর জন্ম ১৯০৩ সালে নোয়াখালীর কাঞ্চনপুর গ্রামে।তার সঠিক কোন জন্মদিন, তারিখের অনুসন্ধান করেও আমি পাইনি বলে এখানে উল্লেখ করতে পারলাম না। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর বংশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর পৌত্র মোতাহার হোসেন চৌধুরীর পিতা ছিলেন সৈয়দ আবদুল মজিদ ও মা ফাতেমা খাতুন। মাতামহ ছিলেন কুমিল্লার বিখ্যাত দারোগা বাড়ির মৌলভি আশরাফ উদ্দীন। পিতা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। কর্মসূত্রে তিনি বাইরে থাকতেন। স্ত্রী ফাতেমা খাতুন সন্তানসহ থাকতেন পিতার কাছে। কিন্তু অল্প বয়সে মোতাহার হোসেন চৌধুরী পিতৃহারা হন। তাই নানাবাড়িতেই বেড়ে ওঠেন তিনি। 

৬.
তিনি কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। এরপর ইউসুফ হাইস্কুলে একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হয়। আমৃত্যু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন তিনি।১৯৪৩ সালে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় এমএ পাস করেন। তার সহপাঠী ছিলেন মুহম্মদ আবদুল হাই ও আহমদ হোসেন। শিক্ষক ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, আশুতোষ ভট্টাচার্য, জসীমউদ্দীন প্রমুখ। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। এ কলেজে কথাসাহিত্যিক আবুল ফজলকে তিনি সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন। 

৭.
তিনি কিশোর বয়সেই সাহিত্যসৃষ্টিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কখনও ছদ্মনামে, কখনও স্বনামে লিখতে শুরু করেন। 'কবিতা' দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে চলা শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে গদ্য লেখায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন । তিনি ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এবং এর সভা ও সম্মেলনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। আসলে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ'- এর সাথে ছিল তাঁর আত্মিক সংযোগ। কেবল সংযোগ নয় , এর সাথে সংশ্লিষ্ট মনীষীবর্গের আদর্শের সাথে তাঁর আদর্শগত সমতাই তাঁকে এই সংগঠনের সাথে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করে। তাঁর রচিত ‘আমাদের দৈন্য’, ‘আদেশপন্থী ও অনুপ্রেরণাপন্থী’ ও ‘মুসলমান সাহিত্যিকদের চিন্তাধারা’ প্রবন্ধ যথাক্রমে সাহিত্য সমাজের পঞ্চম (১৯৩১), ষষ্ঠ (১৯৩২) ও অষ্টম (১৯৩৪) বার্ষিক সম্মেলনে পঠিত হয়। এছাড়া তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৈরাগ্যবিলাস’ প্রবন্ধটি সমাজের মুখপত্র শিখার পঞ্চম বর্ষে প্রকাশিত হয়। আর এভাবেই তিনি সাহিত্যমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিচিত্রা, মোহাম্মাদী, সওগাত, ছায়াবীথি, বুলবুল প্রভৃতি সাহিত্য পত্রিকাতেও তিনি লিখতে থাকেন।অসাধারণ জীবনবোধ ও মার্জিত রুচি তাঁর প্রত্যেকটি রচনায় সহজেই লক্ষ্যগোচর।" অজিত কুমার গুহ বলেছেন "সংস্কৃতিবান লোক ... আপন ধ্যান-কল্পনায় যে সৌন্দর্যলোক, যে রূপজগত সৃষ্টি করেন - তিনি সেই জগতেরই অধিবাসী।" আর এজন্যেই মোতাহের হোসেন বলতেন, "রুচিবান লোক দশের একজন নয়, দশ পেরিয়ে একাদশ।" 

৮.
সমালোচকগণ বলেন, মোতাহের হোসেনের প্রবন্ধের গদ্যশৈলীতে প্রমথ চৌধুরীর এবং মননে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও বিদ্রাহী কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন এমনকি তিরিশের কবিদের কারো কারো ভাব ও শৈলী খুঁজে পাওয়া যাবে তার রচনায়। ইউরোপীয় উদারনৈতিক ভাবধারা দ্বারা মোতাহার হোসেন চৌধুরী গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি ব্যক্তি ও সমাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ চিন্তার ব্যাপারে ক্লাইভ বেল ও ব্রার্টান্ড রাসেল দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিভিন্ন চিন্তানায়ক (দেশে-বিদেশে) তাকে সর্বতোভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন সন্দেহ নেই, তবু তিনি নিজেকে বারবার নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসরমান রেখেছেন। একজন প্রগতিশীল প্রজ্ঞাবান জ্ঞানী সংস্কৃতিবান সমাজসচেতন দায়িত্বশীল মননশীল ব্যক্তির ভেতরে মানবতা ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ, মনুষ্যত্ব, ধর্ম, সংস্কৃতি নিয়ে যে দ্বিধা থাকা স্বাভাবিক তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে সাবলীল গদ্যে যুক্তিনিষ্ঠ হয়ে তিনি কথা বলেছেন। কবিপ্রাণ, প্রেমিক হৃদয় আর সভ্যতার বিশ্বজনীন অনুধ্যান তাকে সাহায্য করেছিল নবচেতনার উদ্বোধন ঘটাতে। আমরা তাঁর চিন্তা দর্শন বক্তব্যকে চেতনায় জাগ্রত করতে আসুন আরো যত্নবান হই।

৯.
সাতচল্লিশোত্তর দেশভাগের ক্রান্তিকালে আমাদের সাহিত্যের আদর্শ, আঙ্গিক ও কলাগত ভাবনায় যখন আমাদের সংস্কৃতিক্ষেত্র চঞ্চল, বিবিধ বৈরী মতবাদ ও মতভেদের প্রচন্ড ঝড়ে আন্দোলিত, তখনো এই নেহাৎ অধ্যাপক মানুষটি নীরবে আপন সাহিত্যকর্মে নিমগ্ন ছিলেন, মতবাদ ও মতভেদের বিভিন্ন ঝঞ্ঝাঘাত থেকে বহু দূরে। এবং সেজন্যই সম্ভবত কোনো দলীয় নামাবলী, ‘মতবাদ’ বা ‘ইজম’ তার লেখাকে আক্রন্ত করেনি, বরং সকল প্রকার মতাদর্শকে অশ্রদ্ধা না করেও তার নিজস্ব ভুবনে, স্বকীয় শিল্পলোকে পরমহংসের মত সন্তরণ করেছেন, আপন সৌরলোকে ঘুরেছেন, তার বিশ্বাস ও চেতনালোক থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। তার দৃঢ় প্রত্যয়ে ও প্রগাঢ় প্রজ্ঞায় তার বক্তব্যের বুনন দৃঢ় এবং সুদৃঢ় ছিল। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতাদর্শের সঙ্গে অনেকে দ্বিমত করতে পারেন, কিন্তু তার লেখার মধ্যে যে সাধুতা, সৎ উদ্দেশ্য, সূক্ষ্মতা ও সাধনা ফুটে ওঠে তা কেউ অস্বীকার করবে না। ইউরোপীয় উদারনৈতিক ভাবধারা দ্বারা মোতাহের হোসেন চৌধুরী গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি ব্যক্তি ও সমাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ চিন্তার ব্যাপারে ক্লাইভ বেল ও ব্রাটার্ন্ড রাসেল দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আর এই প্রভাবেই তিনি তাঁর রচনায় সংস্কৃতি, ধর্ম, মানবতাবোধ ও মানুষের জীবনাচরণের মৌলিক বিষয়গুলি সংজ্ঞায়িত ও উন্মোচিত করতে চেয়েছেন এবং বিচিত্র ও সুন্দরভাবে বাঁচার মধ্যে মহত্তম জীবনের সন্ধান করেছেন। সংস্কৃতি কথা (১৯৫৮) তাঁর প্রধান প্রবন্ধ গ্রন্থ। দ্বিতীয় গ্রন্থ সুখ (১৯৬৫) বার্ট্রান্ড রাসেলের Conquest of Happiness গ্রন্থের এবং তৃতীয় গ্রন্থ সভ্যতা (১৯৬৫) ক্লাইভ বেল-এর Civiliszation গ্রন্থের ভাবানুবাদ।

১০.
যুক্তিনিষ্ঠ প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিতি পেলেও সাহিত্যের বাগানে মোতাহের হোসেনের আগমন ঘটেছে কবিতার হাত ধরে। তৎকালীন প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকা মোসলেম ভারত, সওগাত, নওরোজ, মোহাম্মদী, অভিযান, ভারতবর্ষ প্রভৃতিতে তার অসংখ্য কবিতা ও সনেট প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি ছিলেন রোমান্টিক ধারার কবি আর তার কবিতার পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে অসম্ভব রকমের সৌন্দর্যপিপাসা। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কবিতায় আধুনিকতার কিছু ছোঁয়া থাকলেও তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য গীতিময়তা। এই গীতিময়তার রশি হাতে ধরে তিনি উৎকৃষ্টমানের কিছু গানও লিখেছেন এবং গানগুলো তখন গীত হয়ে প্রচার মাধ্যমগুলোতে রীতিমত প্রচারও হয়েছে। তার একটি গান এরকম :
তোমার কাজল কালো কেশে আমার হৃদয়খানি বাঁধা,
আমি তোমার পাগল কানু, তুমি আমার রাধা।
ফাগুন দিনে ফুলে ফুলে
আঁচল তোমার উঠে দুলে,
বাদল দিনে মনের বনে শুনি তোমার কাঁদা।
তুমি আমার মনের মানিক, তুমি আমার রাধা।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী ম্যাট্রিক পাস করার আগে থেকেই বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা কবিতা প্রকাশ হতে থাকে। বিএ পাসের আগেই তিনি লেখক হিসেবে পাঠকমহলে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৩২৮-এর ভাদ্রে মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার সহজিয়া গান শীর্ষক একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯২০-এর দশকে তিনি প্রচুর গান ও কবিতা লিখেছেন। তার গানে সুরারোপ করেছেন তৎকালীন প্রথিতযশা শিল্পীরা। এই প্রতিথযশা শিল্পীদের অন্যতম ছিলেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু।

১১.
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান রচিত ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরী’ জীবনী গ্রন্থটি এই অসাধারণ সাহিত্যিককে আমাদের কাছে তুলে ধরে। বইটি পড়ে সর্বাগ্রে অনুভূত হয় সাহিত্য চর্চা ছিল তার জীবন চর্চা ও প্রার্থনার অংশ। ক্ষুদ্রায়তন এই পুস্তকটি পাঠককে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কথা স্মরণ করিয়ে দেবে, বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার রাস্তা থেকে ফিরিয়ে আনবে। আরও স্মরণ করিয়ে দেবে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মাহাত্ম্য। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর রচনারীতি সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের নিন্মোক্ত অভিমত প্রণিধানযোগ্য, ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরী বিস্মৃত না হলেও এদেশে একালে তিনি তেমন পরিচিত নন, যতখানি তার প্রাপ্য। তীক্ষ্মধী ও রুচিমান এই জীবনসাধক তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার দৃঢ় প্রকাশে সমকালে শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। তার জীবন ও কীর্তির সামান্য পরিচয়স্থল হলেও এই বইটি তাকে চিনতে সাহায্য করবে বলে আশা করি।’ আরো লিখছেন, ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরীর রচনারীতির বড় গুণ হল যুক্তির পারম্পর্য, ভাষার প্রসাদগুণ ও ভঙ্গির অন্তরঙ্গতা। তার চিন্তা যেমন পরিচ্ছন্ন, তার প্রকাশ তেমনি স্বচ্ছ। তিনি সুপরিচিত কিন্তু সুনির্বাচিত শব্দ ব্যবহার করেন, আর শব্দের বিন্যাস করেন এমনভাবে যাতে তার বাক্য গতিময়তা লাভ করে। ভাবটা সরল হোক আর জটিল হোক, তিনি কথা বলেন সহজ করে। তার মধ্যে কখনো ছড়িয়ে দেন কৌতুকের আভা, কখনো হালকা বিদ্রুপের বক্রতা।’

১২.
আমাদের বাংলার অন্যতম মানবিক চিন্তাবিদ প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সংকলনও চোখে পড়ে। মুহম্মদ সাইফুল ইসলামের সম্পাদনায় ‘সংস্কৃতি সাধক মোতাহের হোসেন চৌধুরী’ প্রকাশিত গ্রন্থটিও বেশ প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই অকুতোভয় লেখকের সামগ্রিক রচনাকর্মের ওপর যে তাত্ত্বিক ও অভিজ্ঞতাযুক্ত আলোচনা আমরা আলোচ্য সংকলনে লক্ষ করি । দীর্ঘ কলেবরে, অনেক লেখার সমন্বয়ে সংকলিত এই সংকলন বাঙালী পাঠককে অন্তত নতুন করে মোতাহের হোসেনকে চিনিয়ে দেবে। নতুন সময়ে নতুনভাবে পাঠক হয়তো আবিষ্কার করবেন এই মননশীল লেখক চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতিসেবককে। এই সংকলন আমাদেরকে সজাগ করে তুলবে আমাদের সাংস্কৃতিক চারিত্র্যকে বুঝে নিতে।

১৩.
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর রচনা থেকে দুটি ঘটনা উদ্ধৃত করা যেতে পারে। একটি হচ্ছে তার এক ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গর্বিত বোধ করায় তিনি ওই ছাত্রকে যা বলেন তার মর্মার্থ : ...‘গৌরব তো বাইরের ব্যাপার, ভেতরের ব্যাপার হচ্ছে আনন্দ। সেই আনন্দের তাগিদেই কবির নামে আমাদের বেশি উল্লসিত হওয়া উচিত। কবিকে গৌরবের বস্তুরূপে দেখা, আর তাকে দূরে সরিয়ে রাখা এক কথা।’ আরেকটি ঘটনা হচ্ছে দু’ছাত্রের- হিন্দু ও মুসলমান- রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে নিয়ে ঝগড়া প্রসঙ্গে তার স্বগতোক্তি : ...‘তুলনামূলক সমালোচনায় অবতীর্ন হতে এদের কোনো সঙ্কোচ নেই। অহমিকাজাত প্রতিযোগিতা-মনোবৃত্তির প্রধান ত্রুটি এই যে, তা মানুষকে সৃষ্টিধর্মী না করে অনুকরণ ও অনুসরণধর্মী করে তোলে।’ মোতাহের হোসেন চৌধুরীর আরেকটি রচনা থেকে খুবই চমৎকার একটি অংশ পাঠ করা যাক।- ‘ভালোবাসার ব্যাপারে পাটোয়ারবুদ্ধি ভালো নয়। যাকে দেবেন সম্পূর্ণভাবেই দেবেন, একেবারে ‘বাকি আমি রাখব না কিছুই’ প্রতিজ্ঞা করে দেবেন। তা না হলে জীবনে বিকৃতি দেখা দেবে। যত দেবেন ততই পাবেন। কার কাছ থেকে? নিজের কাছ থেকেই। যতই ভালোবাসবেন ততই জীবনে স্বাদ পাবেন, স্বাদ পাওয়াটাই বড় কথা।’

১৪.
‘মন রে তুমি কৃষি-কাজ জান না, / এমন মানব জমিন রইল পতিত / আবাদ করলে ফলত সোনা।’- সাধক রাম প্রসাদ সেন
মানব-জনমে ফসল ফলে না নানা কারণে, সোনা ফলা অনেক পরের ব্যাপার।এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো প্রতিরোধের সৃষ্টি করে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রতিবেশ। সেখানে মননের অভাব, প্রীতির অভাব, প্রেমের অভাব, বন্ধুতার অভাব সংযমের অভাব, সবচেয়ে বড় অভাব আত্মমর্যাদার। আর এতগুলো না-থাকা জায়গা করে দেয় নিখিল নিচতা, শঠতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার জন্য। নিজের জীবনে মানুষের অবাধ অধিকার। জগৎকে মেরামত করে এইসব হীনবৃত্তি দূর করার চেয়ে নিজেকে সংশোধন করা অধিক প্রয়োজন। এই কাজে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে সংস্কৃতি চর্চার। ধর্ম নয়, রাজনীতি নয়, মতবাদী নয়, মুক্তির পথ দেখায় সংস্কৃতি – মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়। এই কথা বলেছেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী একান্ত নিভৃতে ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধ সংকলনে। তাঁর ভাবনার আকাশে মেঘের মত ছায়া ফেলেছেন ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তিনি আমাদের শুনিয়েছেন শুভবোধের, নিরঞ্জন বুদ্ধির, উচ্চকিত যুক্তির ও ব্যক্তিপ্রত্যয়ের কথা।

১৫.
সংস্কৃতিই এক অর্থে জীবন। যেখানে উন্নত সংস্কৃতি সেখানেই উন্নত জীবন বলে মোতাহের হোসেন মনে করতেন। তাঁর কথায়, 'কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি।' আর সংস্কৃতির আসল উদ্দেশ্য অন্তরের মধ্যে একটি ব্যক্তিগত জীবন দর্শন সৃষ্টি করা। যিনি তা করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতিবান। ব্যক্তির মধ্যে থাকে যে 'আমি', তাকে সুন্দর করে নির্মাণই সংস্কৃতির কাজ। তার মার্জিত রুচি অন্যায় ও নিষ্ঠুরতাকে ঘৃণা করতে শেখায়। সংস্কৃতি মোতাহের হোসেনের কাছে সমাজতান্ত্রিক নয়, একান্তই ব্যক্তিতান্ত্রিক। তাঁর মতে, 'নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো এ-ই কালচারের আদেশ।' সংস্কৃতি মানুষ স্বতন্ত্র হয়েও সামাজিক। তিনি সমাজের দিকে তাকিয়ে সমাজের প্রয়োজনে নিজেকে সৃষ্টি করেন না, সৃষ্টি করেন নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেরই প্রয়োজনে। তিনি বলেছেন, 'অত্যধিক সমাজচেতনা মানুষকে একপেশে ও প্রমাণ-সাইজ করে রাখে, মানুষের চূড়ান্ত বৃদ্ধিতে অন্তরায় ঘটায়। সমাজের আদেশ : দশের মধ্যে এক হও, এগারো হয়ো না। এগারোদের সে সহ্য করে না- যদিও গৌরবের জন্য মাঝে মাঝে মাথায় করে নাচে। কালচারের আদেশ : দশের মধ্যে এগারো হও, দশের মধ্যে থেকেই নিজেকে নিজের মতো করে, সর্বাঙ্গ সুন্দর করে ফুটিয়ে তোল। তাতেই হবে সমাজের সেবা, যদিও সমাজের বিরক্তি-ভাজন হওয়াই হবে তোমার ভাগ্য।'

১৬.
ব্যক্তিত্বের সাধনা সংস্কৃতির সাধনার মূল ভাবনা। সংস্কৃতিবান মানুষ সে কারণে কোনো 'ইজম' বা মতবাদে আবদ্ধ থাকতে পারেন না। মতবাদে আবদ্ধ থাকা মানে নিজের চিন্তার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করা। চিন্তা ও বিশ্বাসের সমতা বিধান করতে গিয়ে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য লুপ্ত করে বলে রাজনীতির মতো ধর্মও অনেক সময় সংস্কৃতির পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। ধার্মিক মানুষ ধর্ম পালন করেন ভয়ে আর পুরস্কারের লোভে। কিন্তু সংস্কৃতিবান চালিত হন ভালোবাসার তাগিদে। কাউকে তুষ্ট করার দায় থাকে না তার। এ প্রসঙ্গে মোতাহের হোসেন বলেছেন, 'সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয় উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লাহ সৃষ্টি করা।'

১৭.
মোতাহের হোসেন ধর্মকে ফেলে দিতে চান নি, বরং তিনি ধর্মের যাবতীয় গোঁড়ামীকে বাদ দিয়ে তার শক্তি, সৌন্দর্যকে নিয়ে ব্যক্তি হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। ধর্মীয় কিংবা জাতীয় অহমিকা বা শ্রেষ্ঠত্ববোধকে মোতাহের হোসেন মনুষ্যত্ব বিকাশের পরিপন্থী বলে মনে করেছেন। তিনি লিখেছেন, 'ধর্মীয় অহমিকা বা জাতীয় অহমিকার তাগিদে যত কুকান্ড হয়েছে, ব্যক্তিগত কি পারিবারিক অহমিকার তাগিদে তার শতাংশের একাংশও হয় নি। আমরা যখন প্রমাণ করতে লেগে যাই, ইসলাম জগতের শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর হজরত মুহম্মদ (সা.) জগতের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ, তখন তা অহমিকার তাগিদেই করি, মনুষ্যত্বের তাগিদে করি নে।'- যে কোনো সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেই অত্যন্ত সাহসী মন্তব্য। একথা সংশয়হীন অনেকটা যে, মোতাহের হোসেন চৌধুরী শুধু মুসলিম সাহিত্য সমাজের অন্যতম সদস্য ছিলেন না, তিনি বাঙালীর বিশেষত মুসলিম বাঙালীর চিন্তা জগৎ তৈরীতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। বাঙালী মুসলিম মানস গঠনে অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের অবদান স্বীকার করেও তাঁকে উচ্চস্থানে রাখতে হয়। ইউরোপীয় সাহিত্য পঠন-পাঠনজাত বীক্ষণকে মনে রেখেও বলতে হবে, মোতাহের হোসেন তাঁর চিন্তার নিজস্ব পথ নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। ত্রিশ চল্লিশের ওই সময়কালে একজন মুসলিম প্রাবন্ধিকের পক্ষে এর চেয়ে গভীরভাবে, সহজভাবে বাঙালীর বুদ্ধি-প্রজ্ঞা-বিবেচনাকে সংস্কৃতি-ধর্মের নিরিখে এইভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব ছিল না। 

১৮.
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ সংস্কৃতির কথা। এ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ধর্ম্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জ্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্ম্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কাল্চার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা। ধর্ম্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। মার্জ্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কাল্চারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করে। বাইরের আদেশে নয়, ভেতরের সূক্ষ্মচেতনাই তাদের চালক, তাই তাদের জন্য ধর্ম্মের ততটা দরকার হয় না। বরং তাদের উপর ধর্ম্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষ্ম চেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষ্মচেতনার অপর নাম আত্মা। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কাল্চারের উদ্দেশ্য নয়- উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লা সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্ম্মকে যারা গ্রহণ করে তারা আল্লাকে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়। তাই শ’র উক্তিঃ Beware of the man whose God is in the skies- আল্লা যার আকাশে তার সম্বন্ধে সাবধান। কেননা, তার দ্বারা যে কোন অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। আল্লাকে সে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবন যাপন করার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণীর সিট্ রিজার্ভ করার আগ্রহে- অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহলোকে ও পরকালে সর্ব্বত্রই একটা ইতর লোভ। অপর দিকে কাল্চার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে; অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। নিষ্ঠুর হয়ো না- এই তাদের ভেতরের দেবতার হুকুম আর সে হুকুম তারা তামিল না করে পারে না, কেননা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করা কাল্চারের উদ্দেশ্য। যেখানে তা নেই সেখানে আর যাই থাক্ কাল্চার নেই। কাল্চার একটা ব্যক্তিগত ধর্ম্ম। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ।’ [ সূত্র: সংস্কৃতি কথা, মোতাহের হোসেন চৌধুরী]

(অকৃপণ ঋণ/তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, গুণিজন, অনুশীলন, উইকিপিডিয়া, বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, দৈনিক প্রথম আলো, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত