দ্বিজেন শর্মা

প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:২৫

১.
লেখক ও নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা স্যারও চলে গেলেন। দ্বিজেন শর্মা স্যার ছিলেন আজন্মের প্রকৃতি প্রেমিক। আমার খুউব প্রিয় একজন মানুষ, লেখক, প্রকৃতি ও নিসর্গ প্রেমিক দ্বিজেন শর্মা। শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক-সর্বত্রই স্বনামখ্যাত দ্বিজেন শর্মা| বহুমুখী কৌতূহল, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবেশ সুরক্ষা ও সৌন্দর্যায়নের নিরলস কর্মী দ্বিজেন শর্মা আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন বর্ণাঢ্য মানুষ। জীবনের জন্যই প্রকৃতি- ছিলো তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। প্রকৃতি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন তিনি। অন্য বিষয়েও লিখেছেন তিনি। বৃক্ষপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মা অনেক গাছ লাগিয়েছেন। গাছের পরিচর্যা করেছেন। আমাদের হাতে-কলমে বৃক্ষ চিনিয়েছেন। সবুজ প্রকৃতির জন্য লড়ে গেছেন। তাঁর মতোন মমতাময়ী বৃক্ষসখা, অকৃত্রিম মানব ও প্রকৃতি প্রেমিকের বিদায় আমাদের প্রিয় ধরনীর জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। একের পর এক শোক বেদনা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ছে। কত আলোকিত স্মৃতিই না মনে পড়ছে। স্যার, ভালো থাকবেন অনন্তলোকের চিরসবুজ জগতে …

২.
নিসর্গসখা, প্রকৃতিপুত্র নামে খ্যাত দ্বিজেন শর্মা প্রয়াত হলেন। ২০১৭ সালের আজকের দিনে (শুক্রবার ভোররাত ৪টার সময়) স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধী অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় দ্বিজেন শর্মাকে ১৮ আগস্ট বারডেমের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়ছিল। এর আগে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতা ছাড়াও ফুসফুসে সংক্রমণে ভোগা দ্বিজেন শর্মাকে ২৩ জুলাই একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ২৯ জুলাই তাকে আইসিইউতেও নেয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল তার। 

৩.
দ্বিজেন শর্মা ১৯২৯ সালের ২৯ মে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক অর্জনের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন করিমগঞ্জ কলেজ, বিএম কলেজ ও নটর ডেম কলেজে। পরে প্রায় কুড়ি বছর মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে চাকরি করেছেন। এরপর দেশে ফিরে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে। বাংলা একাডেমি, একুশে পদকসহ বিভিন্ন জাতীয় সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। 

৪. 
পরোক্ষভাবে বামপন্থী রাজনীতি করার কারণে কিছুকাল আত্মগোপন, এমনকি কারাবাসও করতে হয়েছে দ্বিজেন শর্মাকে। ১৯৭০ এর জলোচ্ছ্বাসে দুর্গত মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অধিকাংশ সময়ই তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। ১৯৬০ সালে দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে দ্বিজেন শর্মার বিয়ে হয়। তাদের এক ছেলে সুমিত্র শর্মা আর এক মেয়ে শ্রেয়সী শর্মা। দ্বিজেন শর্মা রাজধানীর অসংখ্য জায়গায় গাছ লাগিয়েছেন নিজ হাতে। তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান।

৫.
প্রকৃতি ও নিসর্গবিষয়ক লেখালেখিরও পথিকৃৎ দ্বিজেন শর্মা। উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে লেখা তার আকরগ্রন্থ শ্যামলী নিসর্গ। তার লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে-সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণীবিন্যাস, ফুলগুলি যেন কথা, গাছের কথা ফুলের কথা, এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি, নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা, সমাজতন্ত্রে বসবাস, জীবনের শেষ নেই, বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ, ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি, বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা, গহন কোন বনের ধারে, হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার, বাংলার বৃক্ষ ইত্যাদি। 

৬.
জীবনে অনেকটা পথ পেরিয়ে দ্বিজেন শর্মা আমাদের কাছে জীবন্ত কিংবদন্তি, প্রকৃতির বরপুত্র। প্রকৃতিকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে তার কথা বুঝতে হয় তা তিনি এখানো ছড়িয়ে দিচ্ছেন মানুষের মাঝে। তিনি আমাদের অনেক অজ্ঞতা দূর করেছেন। সেই প্রিয় ও পরম শ্রদ্ধেয় মানুষটি আজ অচেনালোকে চলে গেলেন। স্যার আপনি ভালো থাকবেন।

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত