জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শিক্ষাবিদ প্রফেসর মযহারুল ইসলাম

প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৫৭

১.
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী দেশবরেণ্য সাহিত্যিক প্রফেসর মযহারুল ইসলাম। প্রফেসর মযহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, বৃহত্তর পাবনা (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) জেলার শাহজাদপুর উপজেলার চরনবীপুর গ্রামে। শিক্ষাবিদ প্রফেসর মযহারুল ইসলামের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ ২০০৩ সালের ১৫ নভেম্বর সকাল ৮.১১ মিনিটে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। লোক গবেষক হিসেবে তাঁর নানা রচনা ও গ্রন্থ আমার মতোন অনেকের কাছেই প্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বিশেক করে উল্লেখ করতে হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে তাঁর সুবিশাল জীবনী গ্রন্থটির কথা। তাঁর সন্তান চয়নদা ( Chayan Islam ), লিলিদি’র (Lily Islam ) কল্যাণে তাঁকে নানা সময়ে দেখার যেমন সুযোগ পেয়েছি তেমনি তাঁর একাধিক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার স্মৃতিও মনে পড়ছে আজ।

২.
সাহিত্য সমালোচকদের মতে, প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন বড় মাপের একজন কবি, গবেষক, প্রবন্ধকার ও কথা সাহিত্যিক। সমস্ত জীবন ধরে তিনি সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। একটি বিষয় তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, দেশকে শিল্প-সাহিত্য চর্চায় উন্নত করতে হলে পত্র-পত্রিকার বিকল্প নেই। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমেই নতুন নতুন প্রতিভার জন্ম হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন, পত্র-পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন।

৩.
তাঁর পিতার নাম ডা. মোহাম্মদ আলী। মযহারুল ইসলাম মেট্রিক পাশ করেন তালগাছী আবু ইসহাক উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে, ১৯৪৫ সালে। কৃতিত্বের সঙ্গে আই এ পাশ করেন সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে , ১৯৪৭ সালে। এর পর রাজশাহী সরকারি কলেজে বাংলা বিষয়ে অনার্স নিয়ে বিএ ক্লাশে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে অনার্স পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫০ সালে অনুষ্ঠিত বাংলা এম এ প্রিভিয়াস পরীক্ষায় এবং ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত এম এ ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। একই সঙ্গে তিনি গোল্ড মেডালিষ্ট এবং কালীনারায়ণ স্কলারের গৌরব অর্জন করেন।

৪.
১৯৫২ সালের প্রথম দিকে তিনি ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালে মেধার ভিত্তিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদানের সুযোগ লাভ করেন। ১৯৫৬ সালের গোড়ার দিকে মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর তত্ত্বাবধানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে মযহারুল ইসলাম তাঁর দ্বিতীয় পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন আমেকিার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ডিগ্রি অর্জনের পর এক বছর তিনি আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৪ সালে দেশে ফিরে এসে বাংলা বিভাগের প্রফেসর এবং বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।১৯৬৫ সালে প্রফেসর ইসলাম কলা অনুষদের ডীন নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর পদে আমন্ত্রিত হন। হার্ভার্ডের মেয়াদ শেষ হবার পর তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি এ্যাট বার্কলীতে কিছুদিন ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রফেসর মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনা এবং সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশপাশি দেশে বিদেশে অসংখ্য সেমিনার- সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেন।

৫.
১৯৬৬ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবী উত্থাপনের পর দেশে যে ব্যাপক গণ- আন্দোলন শুরু হয়, সে গণ-আন্দোলনের সঙ্গে মযহারুল ইসলাম একাত্ম হয়ে ওঠেন। ৬ দফা আন্দোলন ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনে রুপান্তরিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজপথে নেমে মযহারুল ইসলাম ৬ দফা এবং স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন , আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে মযহারুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন।।মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সুনির্দিষ্ট নির্দেশ নিয়ে তাঁরা রাত ১০টার দিকে ৩২ নম্বর বাসা থেকে বের হয়ে আসেন। ২৫ মার্চ মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে শুরু হয়ে যায় ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ড. মযহারুল ইসলাম প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেন। এপ্রিল এবং মে মাসে দেশের অভ্যন্তরে থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সংগঠিত করার কাজে মযহারুল ইসলাম নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। বেড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় মূলত তিনি কাজ করেন। কিন্তু জুন মাসের মাঝামাঝিতে এলাকাগুলো যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে চলে যায়, দেশের অভ্যন্তরে তাঁর অবস্থান অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এর ফলে ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনি শাহজাদপুর থেকে পায়ে হেঁটে গোপনে ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। বহু কষ্টে তিনি পায়ে হেঁটে বাঘা লালপুর হয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি যখন বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের জলংগী সীমান্তে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর পরনে ছিল একটি লুংগী, মাথায় একটি গামছা এবং গায়ে একটি গেঞ্জি। পায়ে কোন জুতা ছিল না। স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েদেরকে বাংলাদেশে রেখেই তাঁকে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। নিজের পরিবারের সুখ-শান্তির চেয়ে দেশের স্বাধীনতাকে তিনি বড় করে দেখেছিলেন। পরিবার পরিজনকে এত সব বিপদের মধ্যে রেখেও ড. মযহারুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রতিদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসী ও বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম একই সঙ্গে মুক্তি যুদ্ধ করেছেন কলম দিয়ে এবং অস্ত্র হাতে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হবার পর কাল বিলম্ব না করে ১৯ ডিসেম্বর ( ১৯৭১) ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে যাঁদেরকে কলকাতা থেকে ঢাকাতে নিয়ে আসা হয়, প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ছিলেন তাঁদের একজন।

৭.
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর কয়েকটি অতি গুরুত্তপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই বাংলা দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। কাজেই বাংলা ভাষার উন্নয়ন ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, এজন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী বাংলা একাডেমী। সেই লক্ষ্য অর্জনে ড. মযহারুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দান করেন। তিনি ২২.০৩. ৭২ থেকে ১৮/০৮/ ৭৪ পর্যন্ত বাঙলা একাডেমীর মহা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা একাডেমী পরিচালনায় মযহারুল ইসলাম অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলামের নেতৃত্বে বাঙলা একাডেমি দ্রুত বাংলাদেশের প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নানা জটিলতা দেখা দেয়। সেই সব জটিলতা নিরসনকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ড. মযহারুল ইসলামকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযের উপাচার্য পদে নিয়োগ দান করেন। ১৯৭৪ সালের ১৯ আগস্ট তারিখে মযহারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগদান করেন। 

৮.
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে নিষ্ঠুভাবে হত্যার পর মাত্র এক মাসের মাথায় ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে মযহারুল ইসলামকে উপাচার্য পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর বিবেচনায় রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ তিন বছর তাঁকে কারারুদ্ধ রাখা হয়। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এসে তিনি তাঁর স্থায়ী পদ বাংলা বিভাগের প্রফেসর পদে যোগদানপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে বাংলা বিভাগে তাঁর নিজ পদে যোগদান করতে দেয়া হয় নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন ড. মুহম্মদ আবদুল বারী। এই পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ভারতীয় ইউজিসির আমন্ত্রণে তিনি চলে যান ভারতে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, রাচী বিশ্ববিদ্যালয এবং নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ছয় বছর শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন।

৯.
মযহারুল ইসলাম যখন সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তিনি নদী বিধৌত অঞ্চলের মানুষ। শৈশব থেকেই তিনি নদী, বর্ষা, বৃষ্টি এবং প্রকৃতির নানা লীলা খেলার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করেন। মযহারুল ইসলামের সাহিত্যে তাঁর চার পাশের প্রকৃতি চমৎকারভাবে স্থান করে নিয়েছে। মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিবিড়। লোকায়ত জীবন ও শ্যামল নিসর্গের গভীর স্পর্শ শৈশবেই তাঁকে করে তোলে চঞ্চল, সিক্ত। মাটির সোঁদা গন্ধে তিনি হয়ে ওঠেন বিভোর। মযহারুল ইসলামের জন্মভ’মি চরনবীপুর গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে বহমান যে করতোয়া নদী, বিকেল হলেই মযহারুল ইসলাম সময় কাটাতেন নদীর ঘাটে অবস্থানরত বিশাল বিশাল নৌকার ছইয়ের উপর বসে। তিনি নিবিষ্ট চিত্তে করতোয়া নদীর গতিবিধি লক্ষ্য করতেন, লক্ষ্য করতেন করতোয়া নদী পারের গতিশীল প্রকৃতি ও মানুষকে। পদ্মা যেমন রবীন্দ্রনাথকে কবি করেছে, মযহারুল ইসলামকে কবি হিসেবে গড়ে তুলেছে করতোয়া নদী। জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে রোগশয্যাতেও তিনি করতোয়া নদীর কথা ভুলতে পারেন নি। উদাহরণ-
‘রোগশয্যা পিছে ফেলে কবিতার হাত ধরে
চলে যাই কখন যে কৈশরের
করতোয়া পাড়ে। সেই তিল ক্ষেত জ্যৈষ্ঠ
শেষের জল নতুন জোয়ার। পাতি কাকদের
ভিড়। সেই খেয়া পারাপার।
গামছায় মাছ ধরা। সব কিছু সামনে দাঁড়ায়
সবাই কবিতা।’

১০.
মযহারুল ইসলামের কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা দশের অধিক। উল্লেখযোগ কাব্য গ্রন্থ- মাটির ফসল, বিচ্ছিন্ন প্রতিলিপি যেখানে বাঘের থাবা, অপরাহ্নে বিবস্ত্র প্রাতরাশ, উজানে ফেরার প্রতিধ্বনিআর্তনাদে বিবর্ণ, দুঃসময়ের ছড়া, সাম্প্রতিক ছড়া, রাজবারান্দায় তুমি, কাব্য বিচিত্রা, সন্তরণে নিরন্তর ইত্যাদি। প্রবন্ধ, গবেষণা গ্রন্থের সংখ্যা ২৫-এর অধিক। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ- কবি পাগলা কানাই, সাহিত্য পথে, কবি হেয়াত মামুদ, লোকলোর পরিচিতি ও লোক সাহিত্যের পঠন-পাঠন, ফোকলোর পরিচিতি ও পঠন-পাঠন, লোকাহিনী সংগ্রহের ইতিহাস,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, সতীময়না ও লোর-চন্দ্রানী ( সম্পাদিত) , ফোকলোর চর্চায় রুপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি, কিশোর নবীনদের বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য, কালরাতে ও বর্তমান বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ: কবি, সাহিত্যশিল্পী এবং কর্মযোগী,বিচিত্র দৃষ্টিতে ফোকলোর, আঙ্গিকতার আলোকে ফোকলোর, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অসীম রোদন দুলিছে যেন,,বাঙালি জীবনে ত্রয়ী ও অন্যান্য চিন্তা , রবীন্দ্রনাথ নজরুল ও বাঙালি সংস্কৃতি, সমকালীন রাজনীতি, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের দ্বন্দ্ব-সংঘাত। অনুবাদ গ্রন্থ- বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা, ছোঠ গল্প- তালতমাল, উপন্যাস- এতটুকু ছোয়া লাগে।

১১.
ড. মযহারুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যখন ছাত্র ছিলেন, তখন তিনি সম্পাদনা করেছিলেন ‘ফজলুল হক হল বার্ষিকী।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তিনি যখন বিভাগীয় প্রধান, তথনও তিনি সম্পাদনা করেছিলেন গবেষণাধর্মী ‘সাহিত্যিকী’ পত্রিকা এবং সৃজনশীল ‘উত্তর অন্বেষা’ নামের একটি পত্রিকা। জীবনের অন্তিম প্রহরে তিনি গবেষণাধর্মী অতি উচ্চমানসম্পন্ন ‘ফোকলোর’ পত্রিকা এবং মাসিক ‘মেঘবাহন’ নামে সৃজনশীল রুচিসম্মত যে দুটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন, নানা কারণে পত্রিকা দুটি বিশিষ্টতার দাবিদার। ‘মেঘবাহ পত্রিকার প্রকাশনা আসরেও উপস্থিত থাকার স্মৃতি মনে পড়ছে।স্বীকার করি, পত্রিকাটির কয়েকটি সংখ্যা পাঠ করে ঋদ্ধও হয়েছিলাম। বাংলাদেশ ফোকলোর সোসাইটির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। জাতীয় কবিতা পরিষদ, জাতীয় চার নেতা পরিষদে আজীবন তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৬৮ সালে তাঁকে কবিতায় বাঙলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৭০ সালে তাঁকে তৎকালীন পাকিস্তানের উচ্চতম সাহিত্য পুরস্কার ‘দাউদ পুরস্কার ’ প্রদান করা হয়।

১২.
শিল্প- সাহিত্যের জগৎ ছাড়াও শিক্ষা, জনসেবা, এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুরুত্বপূর্ণ অবদান তিনি রেখে গেছেন। তাঁর নিজ এলাকা শাহজাদপুরে ব্যক্তিগত অর্থে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছেন। নিজ এলাকায় মযহারুল ইসলাম অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার জ্যেষ্ঠ পুত্র চয়ন ইসলাম শাহজাদপুর থেকে নির্বচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। প্রফেসর ইসলাম জীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে শেষ করেছেন শিল্পপতি হিসেবে। শিল্পপতি হলেও তাঁর জীবনে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে কোনরকম ভাটা পড়ে নি। সাফল্যের কোথাও ঘাটতি নেই।

১৩.
জীবনের শেষ প্রান্তে ঠান্ডাজনিত কারণে ফুসফুসে ইনফেকশন দেখা দেয়ায় প্রফেসর মযহারুল ইসলামকে ঘন ঘন বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হচ্ছিল। ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে তাঁর শেষ চিকিৎসা হয়। দেশবরেণ্য এই মহান কবি, শিক্ষাবিদ, পন্ডিত, গবেষক আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফোকলোর বিশারদ, সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রফেসর মযহারুল ইসলাম ২০০৩ সালের ১৫ নভেম্বর সকাল ৮.১১ মিনিটে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগেই তিনি জানিয়ে রেখেছিলেন, তাঁর শেষ ঠিকানা হবে শাহজাদপুর। ১৮ নভেম্বর সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গাজীপুর, বাংলা একাডেমি চত্বর, তালগাছীর করতোয়া কলেজ মাঠ এবং শাহজাদপুরের ডিগ্রী কলেজ মাঠ মোট ৪টি স্থানে তাঁর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার শোক বিহবল মানুষ তাঁর জানাজার নামাজে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ১৮ নভেম্বর বাদ মাগরিব প্রফেসর মযহারুল ইসলামকে শাহজাদপুরে তাঁর ’নূরজাহান’ নামের নিজ বাসভবনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।

১৪.
প্রয়াত পিতার কৃতি সন্তান চয়ন ইসলামের মূল্যায়ন এমন, ‘মানুষ হিসেবে আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি। কারন মানুষের ভালবাসায় আমি মুগ্ধ, আপ্লুত । আর যার কল্যানে মানুষের কাছে এত সম্মান,ভালবাসা, আদর তিনি আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বা প্রফেসর মযহারুল ইসলাম। আমি তাঁর সন্তান হিসেবে গর্বিত । প্রতিটি মুহুর্ত যিনি আমাকে এখনও ছায়ার মত আগলে রাখেন।এখনও মনে হয় প্রতিটি কাজে আব্বাই যেন সবচেয়ে বড় প্রেরণা।’ প্রফেসর মযহারুল ইসলাম মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালবেসেছিলেন, তিনিও মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছেন। এখানেই তাঁর জীবনের বড় সাফল্য।

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত