জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

লিও টলস্টয়

প্রত্যেকেই বিশ্ব বদলে দেয়ার চিন্তা করে কিন্তু নিজেকে বদলানোর চেষ্টা কেউ করে না।- টলস্টয়

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:৫৮

১.
লিও টলস্টয় খ্যাতিমান রুশ লেখক। তাকে রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, এমনকি বিশ্ব সাহিত্যেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের তুলা প্রদেশের ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় ১৮২৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর (পুরাতন ক্যালেন্ডার মতে, ২৮ আগস্ট) কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ টলস্টয় জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর। টলস্টয়কে নিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, ‘টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী’। দস্তয়ভস্কি মনে করতেন, “জীবিত সকল সাহিত্যিকদের মধ্যে টলস্টয় সর্বশ্রেষ্ঠ”। আন্তন চেখভ বলেছেন, “কত প্রতিভাবান একজন শিল্পী এবং মনস্তাত্বিক!!” টলস্টয়ের সততা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ ছিলো বিস্ময়কর। তাঁর মনের গড়ন ছিলো ভাবুকের, দার্শনিকের। সমালোকগণ তাই বলেছেন, সে জন্যই তিনি যখন গল্প-উপন্যাস-নাটক ইত্যাদি সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করতে শুরু করলেন, সেখানে কোথাও অবাস্তব রোম্যান্টিক কল্পনা আমরা দেখতে পাই না। বস্ত্তত মানুষের চিরায়ত কামনা শান্তির অন্বেষাই টলস্টয়ের সাহিত্যকে অমরত্ব দান করেছে। খ্যতিমান কথাসাহিত্যিক টলস্টয় বেঁচেছিলেন প্রায় ৮৩ বছর। কিন্তু স্রষ্টা টলস্টয় মানব সমাজে বেঁচে আছেন আজও প্রবলভাবে তার অমর সৃষ্টি সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে।

২.
‘সবাই নিজের বুদ্ধিতে সন্তুষ্ট, কিন্তু কেউ নিজের অবস্হার ওপর সন্তুষ্ট নয়।’- টলস্টয়
লিও টলস্টয় (জন্ম : ৯ সেপ্টেম্বর, ১৮২৮ - মৃত্যু : ২০ নভেম্বর ১৯১০) Art for Art sake বা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই মতবাদে বিশ্বাসি ছিলেন না– সাহিত্য হবে জীবনের জন্য। তাই দেখা যায় তার প্রতিটি সাহিত্য জীবন ও নীতিবোধ নিয়ে গড়ে উঠেছে। একটি উপন্যাস লিখতে সময় নিয়েছেন ১০ বছর। জীবন ও নীতিবোধ নিয়ে সম্পূর্ণ পরিস্কার ধারণা গড়ে ওঠার পরই লেখায় হাত দিয়েছেন। যেমন নজরুল নিজের ক্ষেত্রে বলেছিলেন, “আমার কবিতা ও গান আমার জীবনের মধ্য থেকে জন্মলাভ করেছে।” সমালোচকদের দৃঢ় মত, টলস্টয় নোবেল প্রাইজ না পাওয়াতে ব্যর্থতা নোবেল কমিটির, টলস্টয়ের নয়। এর কলংক বয়ে বেড়াতে হবে নোবেল কমিটির আজীবন। ঠিক এই কারণে বার্নাড শ’ প্রথমে নোবেল প্রাইজ নিতে চাননি বলেও জানা যায়। তাঁর একাগ্রতা ও পরিশ্রম করার শক্তি ছিলো অসাধারণ, তিনি মেধাবীও ছিলেন। বলা হয়ে থাকে তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতোনই স্বশিক্ষিত ছিলেন। লিও টলস্টয় অনেক ভাষা শিখেছিলেন তিনি- লাতিন, ইংরেজি, আরবি, তুর্কো-তাতার, ইতালীয়, গ্রিক এবং হিব্রু। সঙ্গীতশাস্ত্র এবং চিত্রাঙ্কন বিদ্যাতেও মোটামুটি পারদর্শী ছিলেন তিনি। তার রচনার পরিমাণ ছিল বিশাল ছোটগল্প, বড়গল্প, উপন্যাস, নাটক, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, ডায়েরী, চিঠিপত্র সব মিলিয়ে তার রচনা সমগ্র তৈরি করা হয়েছে। লেখক টলস্টয়ের অভিজ্ঞতার পরিধিও ছিলো বিশাল। সমাজের সবচেয়ে নিচু তলার মানুষ থেকে শুরু করে রাজদরবারের লোকজনের সাথে তিনি মিশতে পারতেন। তিনি তার উপন্যাস বা গল্পের কাহিনীতে সেসব মানুষ, সামাজিক সত্য বা জীবনযাত্রার ছবিই এঁকেছেন যা তিনি নিজে দেখেছেন। তিনি দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন কিন্তু নানা কারণে তাঁর শিল্পী জীবনের অনেকটাই অশান্তির মধ্যে কেটেছে। এই অশান্তির একটি প্রধান কারণ ছিলো- সমাজে বা সভ্যতায় প্রচলিত কোন বিশ্বাস বা রীতিনীতি তিনি বিনা প্রশ্নে মেনে নেন নি বলে। তার জীবন পানে ফিরে তাকালে, আমরা তাই দেখি নানা ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তবে প্রগাঢ় আত্মউপলব্ধি আর প্রবল অনুশোচনা বোধশক্তি তাকে এক অন্য মানুষ বানিয়ে দিয়েছিল, নবজন্ম ঘটিয়েছিল।

৩.
‘পৃথিবীর প্রতিটি সুখী পরিবার একই রকমভাবে সুখী, প্রতিটি অসুখী পরিবার নিজের নিজের ধরণে অসুখী।’ - টলস্টয়
আমরা জানি, রুশ সাহিত্যিকদের মধ্যে টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, পুসকিন, গোগল, চেখভ, গোর্কি প্রমুখের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি। এদের মধ্যে টলস্টয়ের মহিমা ও সুনাম সর্বাগ্রে।সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে, টলস্টয়ের তিনখানি রচনা 'ওয়ার অ্যান্ড পীস', 'আনা কারেনিনা' ও 'রেজারেকশন' মহোত্তম উপন্যাসের জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত; বিশেষ করে 'ওয়ার অ্যান্ড পীস' উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরীতির সর্বোত্তম রূপসৃষ্টি। এ বইটিকেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলা হয়। এগুলোর সঙ্গে নিশ্চয়ই যুক্ত হবে তার '২৩টি গল্প' এবং 'হোয়াট ইজ আর্ট' নামের তাৎপর্যপূর্ণ রচনাগুলো। অথচ এই টলস্টয়েরই প্রথম জীবনের বড় সমস্যা ছিল যে তিনি তাঁর ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্থির করতে পারছিলেন না, তিনি কী লিখবেন, কী করবেন।এমনতর প্রবল সংশয়ের ভেতর তিনি বিখ্যাত লেখক ইভান তুর্গেনেভকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি সাহিত্য-চর্চার যোগ্য নই, তাই লিখব না।’ তুর্গেনেভ সস্নেহে জবাব দিয়েছিলেন, ‘কী আর বলব, আমি তো অতীত। আমাকে ভাঙিয়ে তো তোমার চলবে না, কিন্তু তুমি তো ভবিষ্যৎ। তোমাকে না ভাঙিয়ে আমার চলবে কী করে? সুতরাং লেখো। তুমি লেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারো না’ আর এভাবেই এক অভিভাবক লেখকের ইতিবাচক আশার বাণী টলস্টয়কে পথ দেখায়, স্বপ্ন আলোয় পথ চলতে দিকনির্দেশনা দেয়। সেই তিনিই আবার ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসটি লেখার সময় ১৮৬৬ সালের নভেম্বরে তাঁর সাগরেদ ফেটকে একটা চিঠিতে লিখছেন, ‘আমি তো শুধু চরিত্রগুলোর চেহারা, কাজকর্মের কথা লিখতে চাই না। চাই তাদের ইতিহাস বদলে দিতে।’ অথচ অভিজাত রুশ পরিবারের তরুণ কাউন্ট টলস্টয়ের প্রথম দিকের জীবন ছিল কর্কশ, চরিত্রভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট। তাসের জুয়া খেলায় ছিলেন আসক্ত। ‘অ্যা কনফেশন’-এ তিনি স্বীকার করেছেন: ‘যুদ্ধে মানুষ হত্যা করেছি, তাদের হত্যা করার জন্য দ্বন্দ্বযুদ্ধে লড়েছি, তাসের জুয়া খেলে হেরেছি, কৃষকের শ্রম শোষণ করে ভোগ করেছি, তাদের নানা শাস্তি দিয়েছি, যেনতেনভাবে চলেছি, মানুষকে ঠকিয়েছি। মিথ্যা বলা, ডাকাতি, সব ধরনের ব্যভিচার, নেশা পান, সন্ত্রাস, খুন এমন কোনো অপরাধ নেই যা আমি করিনি। এরপরও মানুষ আমার আচরণের প্রশংসা করেছে, আমার সমসাময়িকেরা বারবার আমাকে তুলনামূলকভাবে একজন নীতিবান মানুষ বলেই বিবেচনা করেছে। এভাবেই কেটেছে আমার ১০ বছর।’

৪.
টলস্টয়কে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের রচিত বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় ১৩টি প্রবন্ধ নিয়ে ১৯৮০ সালে বেরিয়েছিল 'টলস্টয়'। বাঙালির টলস্টয় পাঠের এক অনবদ্য নিদর্শন এই বই। এই বই পড়েই টলস্টয়কে প্রথম বোঝার চেষ্টা শুরু হয় আমার মত অনেকেরই। খুব করে মনে পড়ছে, ‘কাউন্ট লিও তলস্তয়ের হৃদয়সংবেদী ডায়েরি’ প্রবন্ধে সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের কথাটি। তিনি ঠিকই বলছেন, ‘বাংলায় তলস্তয়-চর্চা খুব কম। সাধারণ নভেল পাঠকদের কথা ধরছি না, যাঁরা নভেল লেখেন তাঁদের পক্ষে তলস্তয় যেন তত অবশ্যপাঠ্য নয়, পুনর্পাঠ্য তো নয়ই।’' টলস্টয়'-এ টলস্টয়ের জীবন কাহিনী নেই বটে, তবু বলতে হবে এই বইয়ের নানা আলোচনায় টলস্টয় জীবনের উল্লেখযোগ্য চিত্র ও ঘটনাগুলোর প্রসঙ্গ আছে। তাঁর জীবনজিজ্ঞাসার গুরুতর প্রসঙ্গগুলোর কোনোটাই বাদ পড়েনি। অন্নদাশঙ্কর টলস্টয়ের একাধিক নারী সংসর্গের প্রসঙ্গও উত্থাপন করেছেন অকাতরে। টলস্টয়ের গৃহত্যাগের ও জীবনের বিয়োগান্ত সমাপ্তির করুণ আলেখ্য টলস্টয়- অনুরাগীদের ব্যথিত করবে। টলস্টয়ের তিনখানি মহৎ উপন্যাসের আলোচনাও করেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়। বইয়ের ভূমিকায় জানিয়েছেন, 'আনা কারেনিনা'র শতবর্ষ পূর্তিও তার স্রষ্টার জন্মের সার্ধশত বর্ষপূর্তির সমসাময়িক। তাই আমি আনা কারেনিনাকেই আমার এই প্রবন্ধ সংগ্রহের মধ্যমণি করেছি।' 'ওয়ার অ্যান্ড পীস' ও 'আনা কারেনিনা' টলস্টয়ের নিজের মতে মহৎ রচনা নয়; অথচ এ বই দুটি তাকে ভুবন বিখ্যাত করেছে, সঙ্গে অবশ্য 'রেজা রেকশন'ও যুক্ত, যে বইতে আছে বারবনিতার পুনরুজ্জীবন (টলস্টয়ের মতে পুনর্বিকিরণ) লাভের এক অসাধারণ শিল্পকীর্তি। 'ওয়ার অ্যান্ড পীস' (অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষায় সমর ও শান্তি) প্রসঙ্গে পুনরাবৃত্ত রসনা বলে যায়, "যে বই বারবার শতবার পড়েও তৃপ্তি হয় না, আবার পড়তে ইচ্ছে করে, সেই বইই ভালো বই : তেমন ভালো বইয়ের তালিকায় টলস্টয়ের 'সমর ও শান্তি' শীর্ষস্থান অধিকার করে আছে স্বদেশে বিদেশে সবদেশে।" আনা কারেনিনা মহৎ প্রেমের চিরকালীন আখ্যান। অন্নদাশঙ্কর মনে করেন, টলস্টয়ের তিনখানি উপন্যাসই মহাকাব্যিক এবং তিনখানি উপন্যাসের কলাবিধিতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

৫.
প্রত্যেক বড় শিল্পীরই জীবনাদর্শ থাকে এবং সেই আদর্শ শিল্পীর রচনাতেই অভিব্যক্ত হয়। অন্যের কাছ থেকে সে আদর্শের প্রভাব লাভ করতে আপত্তি নেই, যদি তা মহৎ হয়। অন্নদাশঙ্কর রায়ও টলস্টয়ের সাহিত্যাদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেজন্য টলস্টয়ের প্রতি তাঁর ভক্তিপ্রীতি নিরঙ্কুশ। টলস্টয়কে নিয়ে তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে। টলস্টয়ের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের বছরে (১৯৭৮) তার প্রবন্ধগুলো 'টলস্টয়' নামে সংবলিত হতে থাকে এবং প্রকাশ পায় ১৯৮০ সালে। মোট ১৩টি ছোট-বড় প্রবন্ধের সঙ্কলন। এ সঙ্কলনের ভূমিকাতে অন্নদাশঙ্কর রায় জানাচ্ছেন যে, টলস্টয়ের কাছেই তাঁর সাহিত্যিক শিক্ষানবিশির সূচনা হয়। শিক্ষানবিশির প্রমাণ তার ১৬ বছর বয়সে কৃত টলস্টয়ের টুয়েনটি থ্রি টেলসের একটি টেলের অনুবাদ 'তিনটি প্রশ্ন' নামে, যা গ্রন্থটির পরিশিষ্টে যুক্ত। 'টলস্টয় : সার্ধশতবার্ষিকী' রচনাটিতে তিনি শিক্ষানবিশির প্রসঙ্গ আবার তুললেন এটি জানাতে যে, ১৬ বছর বয়সে স্কুলের ছাত্র হিসেবে তিনি টলস্টয়ের কাহিনীগুচ্ছ (টুয়েনটি থ্রি টেলস) কোনো উপলক্ষে পুরস্কার পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দুটি কাহিনীর অনুবাদ করেন এবং উপরোল্লিখিত রচনাটি সঙ্গে সঙ্গেই প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জানাচ্ছেন, 'সেই যে সম্পর্ক স্থাপিত হলো সে সম্পর্ক সারা জীবনেও ছিন্ন হলো না। জীবন দর্শনের ক্ষেত্রে আমি তাঁর অনুচরদের সঙ্গেই রয়েছি।' এই কথা বলে তিনি এও জানাচ্ছেন, 'কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব কাটিয়ে উঠেছি।' টলস্টয় যে পঞ্চাশ উত্তীর্ণ বয়সে সাহিত্যকে ধর্ম ও নীতি প্রচারের বাহন করেছিলেন, সেটি অন্নদাশঙ্করের মনঃপুত নয়। কারণ, 'আমার মতে, এতে আর্টের স্বাধীনতা খর্ব হয়। অমিতাচারী আর্টকে সংযত হতে বলা এক জিনিস, শৃঙ্খলার খাতিরে শৃঙ্খল পরিয়ে দেয়া আরেক। শিবের জন্য সৌন্দর্যকে লাঘব করা যায় না।' বোঝা যায়, অন্নদাশঙ্কর বিশুদ্ধ আর্টতত্ত্বের ছাত্র। সেজন্য রবীন্দ্রনাথের সমীপবর্তী বলে তিনি নিজেকে মনে করেন। সম্ভবত এ কারণে যে, প্রচার না করে আর্টকে বজায় রেখে তাঁরা দুজন মানুষ সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি নিয়ে লিখতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও কবি, অন্যদিকে টলস্টয় হলেন কাব্যরস-বিবর্জিত। এ কথাগুলো তিনি পরের বছরে (১৯৭৯) লেখা 'টলস্টয়ের উপকথা' রচনায়ও পুনরাবৃত্তি করেছেন_ 'তিনটি প্রশ্ন', 'লেখাটা আমার নয়, টলস্টয়ের। নইলে ছাপা হতো না। তারই দৌলতে আমার ছাপার অক্ষরে নাম ওঠে। সেই আমার প্রথম প্রকাশিত বাংলা রচনা। যদিও অনুবাদের কাজ।' এই লেখাতেই আমরা জানতে পারি, তিনি অজান্তেই টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পীসের অনুকরণে 'সত্যাসত্য' (ছয় খন্ডে সমাপ্ত) এবং 'আনা কারেনিনা'র অনুকরণে 'রত্ন ও শ্রীমতি' নামের দুটি বড় বাংলা উপন্যাস লিখেছেন। ১৯২০ সালে রচিত 'তিনটি প্রশ্নের' অনুবাদক কী করে কোন্ রূপে লেখক হয়ে ওঠেন সে বৃত্তান্তও আছে, 'বড় হয়ে আমিও একজন লেখক হয়ে উঠি। কিন্তু টলস্টয়ের আদর্শে নয়। কতকটা রবীন্দ্রনাথের, কতকটা প্রমথ চৌধুরীর, কতকটা রম্যা রঁলার, কতকটা পশ্চিম ইউরোপীয় সাহিত্য রথীদের।' অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখক সত্তার নাম বিনু। 'বিনুর বই' নামে বইও তার আছে। সে রকম রচনায়ও (১৯৪৪) টলস্টয়ের সঙ্গে তার সাদৃশ্যের কথা আবার উল্লিখিত। 'অন্যতম গুরু টলস্টয়' নামের লেখাটি ওই সাদৃশ্যের প্রসঙ্গই তুলে ধরে।

৬.
আমার কাছে টলস্টয় মানেই তার সেই গল্পটির ছবি ভেসে ওঠা। আমাদের প্রায় অনেকেরই পড়া সেই গল্পটা। হিংসা,লোভ, ঘৃণায় ভরা এই পৃথিবীতে টলস্টয় আজো সেই চিরায়ত প্রশ্নটিরই পুনরাবৃত্তি করেন, যেটার নাম ছিল ‘How much land does a man require?’ আসলেই আমাদের আর কতটুকু জমি দরকার….? অথচ নানা বৈপরিত্তে ভরা সেই টলস্টয়েরই জীবন ছিল রোমাঞ্চকর পরিব্রাজকের। ভ্লাদিমির শের্টকভ `লাস্ট ডেজ অব লিও টলস্টয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘১ নভেম্বর, ১৯১০ তারিখে আলেকাজান্দ্রার মাধ্যমে টলস্টয় তার ডায়েরিতে লেখেন : 'সবার মধ্যে ঈশ্বর হচ্ছেন অনন্ত অসীম। মানুষ হচ্ছে তার সসীম প্রকাশ। কিংবা বলা যায় : সবার মধ্যে ঈশ্বর এমন অসীম যে, মানুষ নিজেকে তার সসীম অংশ বলে জানে।' 'কেবল ঈশ্বর সত্যিকারভাবে বিরাজমান। মানুষ নিজেকে সময়, স্থান ও বস্তুর মধ্যে প্রকাশ করে। অন্যান্য সত্তার সঙ্গে যত বেশি মানুষের প্রকাশ ঘটে মানুষের অস্তিত্ব তত বেশি বিরাজমান থাকে। অন্য প্রাণীর সঙ্গে জীবনের এই ঐক্য ঘটে ভালোবাসার মাধ্যমে।''ঈশ্বর ভালোবাসা নয়; কিন্তু ভালোবাসার কথা যত বেশি বলা হয় তত বেশি মানুষ ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটায়, তত বেশি তিনি সত্যিকারভাবে বিরাজমান থাকেন..."লিও টলস্টয় তার জীবদ্দশায় যে জাগতিক সুখ-ভোগ ও বিলাস-ব্যাসনে মত্ত হয়েছিলেন সে জন্য সারাজীবন তার বিবেকের দংশন ছিল। তিনি কখনও ভুলে যাননি, সাধারণ মানুষের কারণেই বিলাস-ব্যাসন পূর্ণ জীবনযাপন করতে পেরেছিলেন, তাদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়েই লাভ করেছিলেন বিলাসী জীবন।’ (অনুবাদ : দিলওয়ার হাসান)।

৭.
লিও টলস্টয় প্রচণ্ড একরোখা মানুষ ছিলেন বটে, রাশিয়ান জারের কিংবা সরকারের কোনকিছুই, বলা চলে যে কোনো ধরণের রাষ্ট্রযন্ত্রেই তার ছিল প্রবল অনাস্থা৷ কোনো সরকার ব্যবস্থাকেই ঠিক পছন্দ করতেন না৷ কিন্তু তাই বলে যে অঢেল রত্নের প্রাচুর্য তিনি রাশিয়াকে দিয়ে গেছেন তাঁর সুবিশাল, মহৎ সৃষ্টি, সমুদয় সাহিত্যকর্ম বাবদ৷ কি দর্শনে, কি জীবনাচরণে টলস্টয়ের মতোন একরোখা, নীতিবান এক মহান লেখককে ভুলে থাকা কী সম্ভব ? একটি চমকপ্রদ ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। টলস্টয় একবার তার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য নিয়ে যান। সেখানে ভর্তি ফরমে এই মর্মে পিতার অংগীকার করতে হয় যে ‘সন্তান স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে কোনো সময় অনাকাংখিত ব্যবহার করবে না’। টলস্টয় বেঁকে বসলেন, তার পরিস্কার জবাব “নিজের ব্যবহার বিষয়ে অংগীকার করা যায়, কিন্তু অন্যের ক্ষেত্রে কিভাবে সম্ভব?” স্কুল কর্তৃপক্ষ যতই টলস্টয়কে বুঝায়, এটা তাদের ফরমাল নিয়ম, টলস্টয় বুঝতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত তার সন্তানকে সেই স্কুলে আর ভর্তি করালেন না।

৮.
জীবনী শক্তি ও কর্মোদ্যম ছিল দানবীয় রকমের প্রচন্ড। ভালো শিকারি ছিলেন এবং ভয়ংকর একগুয়ে স্বভাবের ছিলেন। একবার ভালুক শিকারে গিয়েছিলেন, একটা ভালুক থাবা মেরে চোখের নিচে থেকে বাঁ দিকের গাল ছিড়ে নামিয়ে দেয়; দুই সপ্তাহ পরে ভালো হয়ে তিনি ফের শিকারে যান এবং ঐ ভালুকটিকে বধ করেন। বন্ধু-বান্ধব বা সমাজ কী বলবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজে যা উচিত এবং ন্যায্য বলে ভেবেছেন তাই করেছেন সবসময়। শান্ত-সুবোধ প্রকৃতির ছিলেন না, যৌবনে প্রচুর ধার-দেনা করেছেন এবং বিষয় সম্পত্তি নষ্ট করেছেন। অন্যদিকে, জার সম্রাটের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই মুখর ছিলেন, স্বনামে ও বেনামে দেশের ভিতরে ও বাইরে জার-শাসনের সমালোচনা করে লেখা ছাপিয়েছেন। আবার আইনের নামে বিচারের প্রহসন কিভাবে হয় তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য দিনের পর দিন আদালত আর জেলখানায় ঘুরেছেন। 

৯.
টলস্টয়ের ধর্মবোধ ছিল প্রখর তীক্ষ্ম। তার নানা রচনায় দেখি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অন্তর্দ্বন্দ্বে পীড়িত, যৌক্তিক একজন মানুষকে টলস্তয় শেষ পর্যন্ত বাইবেলের বাণীতে মুক্তি দিয়েছেন। টলস্তয়ের বেলায় এমনই হয় প্রায়শ। তারপরও বিপ্লব ও প্রতিরোধবিরোধী ধর্মপ্রচারক টলস্তয়কে ছাপিয়ে ওঠেন শিল্পী টলস্তয়, লেনিন তাঁকে বলেছেন, ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ’। টলস্টয় তার গল্প উপন্যাসের বহু জায়গায় বাইবেলের বাণী উদ্ধৃত করেছেন।তবে খ্রিস্টধর্মের অমানবিক যাজক প্রথা, যাকে টলস্টয় মনে করতেন নিজ ধর্মের সবচেয়ে বড় গোঁয়ার্তুমি। তার বিপরীতে তিনি স্থাপন করেছিলেন মানবতার শাশ্বত বাণী। বাস্তব জীবনে টলস্টয় পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন। তৎকালীন পাদ্রী এবং ইসলামিক স্কলারদের সাথে টলস্টয় মত বিনিময় করতেন। অনেকে চিঠির মাধ্যমে টলস্টয় এর কাছে ধর্মীয়ে বিষয়ে জানতে চাইতেন। আমাদের বাংলা সাহিত্যে তুলনামূলক ধর্মের ক্ষেত্রে যেমন কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও সৈয়দ মুজতবা আলীর ছিল অগাধ জ্ঞান। টলস্টয় পাদ্রী-পুরুতদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের সমালোচনা করেছেন, এবং তার শাস্তি স্বরূপ যাজক সম্প্রদায় ঘোষণা করেছেন যে, টলস্টয়কে খ্রিস্ট ধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হল, তিনি আর খ্রিস্টান বলে গণ্য হবেন না। এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে যারা ঈশ্বর ও যীশুকে নিয়ে ব্যবসা করে তাদের চেয়ে তিনি সহস্র গুণ বেশী ধার্মিক খ্রিস্টান।

১০.
লিও টলস্টয়ের জীবনের অতি গুরুত্বময় ছয়টি শিক্ষার কথা জেনে নেওয়া যাক। টলস্টয় যখন কলম হাতে নেন এবং শুরু করেন তার নবযুগ সূচনাকারী সাড়া জাগানো বই ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ লেখা। বেশির ভাগ মানুষ তাকে জানেন ঊনবিবংশ শতাব্দীর একজন বড় মাপের ঔপন্যাসিক হিসেবে। আমরা কম লোকই জানি, তিনি ছিলেন সে সময়ের বড় ধরনের প্রগতিবাদী, বৈপ্লবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। ১৮২৮ থেকে ১৯১০ পর্যন্ত সুদীর্ঘ জীবনকালে তার জীবনের অভিজাত প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা বিশ্বাস তিনি ক্রমে ক্রমে বাতিল করে দেন এবং বিশ্ব সম্পর্কে ধারণ করতে শুরু করেন অবাক করা সব অপ্রচলিত ধারার ধারণা। বিষয়টি তার বন্ধুবান্ধবকে ভাবিয়ে তোলে। কারো কারো তা মনোকষ্টেরও কারণ হয়ে ওঠে। তার এই পরিবর্তন লক্ষ করলে তার জীবন থেকে বেশ কিছু আশ্চর্যজনক ও জ্ঞানগর্ভ জীবনশিক্ষার সন্ধান পাই। এসব শিক্ষা জানিয়ে দেয়, কী করে আমরা আজকের দিনের নানা দ্বন্দ্বে দ্বান্দ্বিক জগতেও একটি শৈল্পিক সুন্দর ধ্রুপদ জীবন পরিচালনা করতে পারি। কী করে তিনি নিজেকে জীবনের নানা সংকট থেকে বের করে নিয়ে এলেন এ ধরনের অবাঞ্চিত অবক্ষয়ী জীবনাচার থেকে? আর কী করেইবা তার এই জীবনযাত্রা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে আমাদের জীবনদর্শন নির্ধারণের ভাবনায়? আসুন এক এক করে জেনে নেয়া যাক টলস্টয়ের জীবন থেকে তুলে আনা ছয়টি জীবনশিক্ষা। জীবনশিক্ষা- ১ : মনটাকে মুক্ত রাখুন, ২ : অন্যের অনুভূতির সাথে একাত্ম হোন, ৩ : নিজেকে ভিন্নতর করে তুলুন, ৪ : সরল জীবনযাপন আয়ত্ত করুন, ৫: নিজের স্ববিরোধিতা সম্পর্কে সতর্ক থাকুন, ৬ : বাড়িয়ে নিন নিজের সামাজিক বলয়। আমরা যদি আমাদের বিশ্বাস ও ধারণা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে চাই, আমাদের প্রয়োজন টলস্টয়ের উদাহরণ অনুসরণ করা সেসব মানুষের সাথে সময় কাটানো, যাদের মূল্যবোধ ও প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা আমাদের মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতার বিপরীত। আমাদের কাজ অবশ্যই হবে, বৃত্তের পরিসীমা ছাড়িয়ে পরিভ্রমণ।

১১.
লিও টলস্টয়ের পিতা নিকোলাই ইলিচ টলস্টয় ছিলেন জমিদার এবং মা মারিয়া নিকোলায়েভনা টলস্টয়াও ছিলেন সম্ভ্রান্ত মহিলা। তিনি ছিলেন পরিবারের চতুর্থ সন্তান। শিশু বয়সে তার বাবা মা মারা যান এবং আত্মীয় স্বজনরাই তাকে বড় করেন। ১৮৩০ সালে টলস্টয়ের পিতা এবং ১৮৩৭-এ মা মারা যান। তাঁর একাগ্রতা ও পরিশ্রম করার শক্তি ছিলো অসাধারণ, তিনি মেধাবীও ছিলেন। পাঁচ-ছ বছর বয়সেই তিনটি ভাষা শিক্ষায় হাতেখড়ি হয় তাঁর-মাতৃভাষা রুশ, ফরাসী ও জার্মান ভাষায়। পারিবারিক পরিবেশে শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করার পর ১৮৪৪-এ টলস্টয় কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ও তুর্কী ভাষা বিভাগে ভর্তি হন। পরের বছর বিভাগ পরিবর্তন করে স্থানান্তরিত হন আইন অনুষদে। তিন বছর পরে অসমাপ্ত শিক্ষায় ইতি টেনে ফিরে আসেন নিজ জন্মভূমিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ছেড়ে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন লেখালেখিতে। পরবর্তী কয়েক বছর ‘লক্ষ্যহীন উশৃঙ্খল’ জীবনযাপন করেন মস্কো, সেন্ট পিটার্সবুর্গ এবং অন্যান্য শহরে। এ সময় স্নাতক পরীক্ষা দেবারও নিষ্ফল চেষ্টা করেন। ১৮৫১ সালে ভাই নিকোলাইয়ের কাছে বেড়াতে যান ককেশাস অঞ্চলে এবং তাদের ব্যতিক্রমী জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত হন। ককেশীয় জীবন ও যুদ্ধ নিয়ে অনেক লেখার পটভূমি এখান থেকেই তাঁর মনে রেখাপাত করে। টলস্টয় ১৮৫২ সালে ক্যাডেট হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। চেচেনদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে চতুর্থ শ্রেণীর গোলন্দাজ হিসেবে নন-কমিশনড্ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন । ১৮৫৪ সালে জুনিয়র সেনাপতি পদে নিযুক্তি পান এবং ১৮৫৬ সালে লেফটেন্যান্ট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

১২.
টলস্টয়ের প্রথম রচনা ‘শৈশব’ প্রকাশিত হয় ১৮৫২ সালে। এভাবেই গল্প দিয়ে টলস্টয় যাত্রা শুরু করেন সাহিত্যে। তিনি ছিলেন ধীরগতি লেখক। সমস্যা কিংবা অব্যবস্থা যখনই তাঁর মনকে আলোড়িত করেছে তখনই তার উপর কাহিনীর খসড়া নির্মাণ করেছেন। কিন্তু সেই কাহিনী অথবা গল্প পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে বহু বিন্যাস ও পুননির্মাণের মাধ্যমে- কয়েক মাস, বছর কিংবা জীবনের শেষ লগ্নে এসে। এ জন্য টলস্টয়ের লেখার ক্রমধারা প্রকাশনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বরং তার জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল। তার সাহিত্য তার জীবনের মতোই অদ্ভুত। উপন্যাসাশ্রয়ী। গল্প প্রায়শই দীর্ঘ, অনুপুংখ বিশ্লেষণ, কমা ও সেমিকোলনের পৌনঃপুনিক ব্যবহার এবং (মনোবিশ্লেষণের প্রয়োজনে) প্রেক্ষাপট বিবরণে সমুজ্জ্বল। প্রকাশের তাড়াহুড়া না থাকায় শতবর্ষের কাহিনী বিস্তার এবং মহাদেশীয় মানসিকতা উপস্থাপিত হয়েছে কখনো জাতিসত্তায় (যুদ্ধ ও শান্তি), কখনো পরিবারকে ঘিরে (আন্না কারেনিনা) এবং শেষ অব্দি সকলকে তুচ্ছ করে ব্যক্তিতে (পুনরুজ্জীবন)। যুদ্ধের নায়ক আঁদ্রে, পরিবারের ভ্রনস্কিতে ঠাঁই না পেয়ে পরিণতি পেয়েছে নেখলুদভে। এই দীঘ পরিবর্তনের ফাঁকে ‘কাল’ অতিক্রম করেছে দীর্ঘ পথযাত্রা (যুদ্ধ ও শান্তি প্রকাশের ৮ বছর পর বেরোয় আন্না কারেনিনা এবং এর ২১ বছর পর প্রকাশিত হয় পুনরুজ্জীবন)। সেই অবসরে রচিত হয়েছে তার গল্প, নাটক, প্রবন্ধ ও সন্দর্ভ। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে উপন্যাস ও গল্পই মর্যাদা পেয়েছে সর্বাধিক। তার প্রধান সৃষ্টিকর্ম (তিনটি উপন্যাস) দিয়ে তিনি যে জীবনদর্শনে পৌঁছাতে চেয়েছেন (“হোয়াট ইজ আর্টে” যার সরল বর্ণনা রয়েছে) তার মধ্যবর্তী শূন্যতা পূরণ করেছে তার গল্পসম্ভার। দেশ থেকে পরিবার, পরিবার থেকে ব্যক্তিত্বে পৌঁছানোর ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে সহজ স্বাভাবিক মনে হলেও-এটা ছিল উনবিংশ শতাব্দীর রুশ (এমনকি বাকি পৃথিবীর জন্যেও) জীবনের জন্য এক অবিশ্বাস্য উত্তরণ। আবার, তিনি নিজেও তার সৃষ্টির খাপছাড়া চরিত্রটি স্পষ্ট জানতেন এবং এ কারণে তার অনেক রচনাকে তিনি নিজেই খারিজ করেছেন ‘অনুত্তীর্ণ’ বলে “উপরন্ত আমি অবশ্যই উল্লেখ করবো যে, আমি আমার নিজের শৈল্পিক সৃষ্টিগুলোকে অসৎশিল্পের পর্যায়ভুক্ত করি। কেবলমাত্র ‘ঈশ্বর সত্যকে দেখেও অপেক্ষা করেন’-গল্পটি এর ব্যতিক্রম। এ গল্পটি প্রথম শ্রেণীতে স্থান দাবি করে এবং ‘ককেশাসের বাদী’ শীর্ষক গল্পটি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে’ (হোয়াট ইজ আর্টের ষোড়শ অধ্যায়ের টীকা)।

১৩.
টলস্টয় ১৮৫৭ সালে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানীতে প্রথম বিদেশ ভ্রমণ থেকে ফিরে এসে স্থায়ীভাবে ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় বসবাস শুরু করেন। চাষী ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল খোলেন এবং নিজেই শিক্ষকতার ভার নেন। পরের বছর ইংল্যান্ড ও বেলজিয়াম সফর করেন। ১৮৬১ সালে ভূমিদাস প্রথা বিলোপের মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত হন। এ সময় ‘ইয়াস্নোয় পলিয়ানা’ নামের একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার সন্দেহে পুলিশ তার বাসভবন তল্লাশি করে।

১৪.
ব্যক্তিগত জীবনে ১৮৬২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর টলস্টয় বিয়ে করেন জার্মান বংশোদ্ভূত রুশ সোফিয়া আন্দ্রেইভনাকে। তারা ছিলেন ১৩ সন্তানের জনক-জননী৷ দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিকটা তাদের সুখের হলেও পরে অশান্তি দেখা দেয়৷এ নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহীজন অধ্যাপক মোবাশ্বের আলীর লেখা গ্রন্থ ‘শিল্পীর ট্রাজেডী’তে ‘টলস্টয়ের বিবাহিত জীবন’ রচনাটি পড়ে দেখতে পারেন। 

১৫.
টলস্টয় “যুদ্ধ ও শান্তি” রচনা শুরু করেন ১৮৬৩ সালে এবং শেষ করেন ১৮৬৯ সালে। ১৮৭০ সালে মূল হোমার পাঠ করার জন্য গ্রীক শেখেন। ১৮৭১-এ শিশুদের জন্য রচনা করেন “অআকখ”। ১৮৭৩-এ “আন্না কারেনিনা” রচনায় হাত দেন এবং ১৮৭৭ সালে শেষ করেন। ১৮৮০-তে চার্চের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৮৮২ সালে গরীব ও অন্ত্যজ শ্রেণী সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আদম শুমারীতে অংশগ্রহণ করেন। পরের বছর রচনা করেন লোককাহিনী ভিত্তিক গল্পমালা। সাধারণ পাঠ্য বিষয়ক প্রকাশনালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন এই একই বছর। ১৮৯১ সালে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে পূর্বে প্রকাশিত সমস্ত রচনার স্বত্ত্ব ত্যাগ করেন। মোপাঁসার রচনাবলীর জন্য ভূমিকা লেখেন। “অন্ধকারের ক্ষমতা” ও “হাজী মুরাদ” উপন্যাস লিখিত হয় ১৮৯৩ এবং ১৮৯৬-তে। পরের বছর বেরোয় সর্বাধিক বিতর্কিত গ্রন্থ “হোয়াট ইজ আর্ট?”। “পুনরুজ্জীবন” ও “সমালোচনা সংগ্রহ” প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালে।

১৬.
১৯০১ সালে অর্থোডক্স চার্চ টলস্টয়কে ধর্মত্যাগী ঘোষণা করে। কিন্তু মস্কোর সাধারণ নাগরিকরা তাকে ‘ঋষি’ বলে সংবর্ধনা জানায়। ১৯০২ থেকে ১৯১০ পর্যন্ত টলস্টয় লেখেন রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ, ধর্ম ও জীবনবোধ নিয়ে বহু প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। “আন্না কারেনিনা”র পর থেকেই তার যে মনঃসংকট ও জিজ্ঞাসা শুরু হয়েছিল, ১৯১০-এ এসে তা চূড়ান্ত শান্তি খোঁজে। 

১৭.
টলস্টয় মারা যাবার ১০ দিন আগে অভিমানে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং “আস্তাপভ” নামক এক অখ্যাত স্টেশনে একজন অজ্ঞাত পথিক হিসেবে ১৯১০ সালের ২০ শে নবেম্বর সকাল ৬টা ৫ মিনিটে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। আর সে সময় তার পকেটে ছিল ২৯ রুবল এবং হাসান সোহরাওয়ার্দীর সম্পাদনায় প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সেইংস অব হযরত মোহাম্মদ(স:)’। আর এভাবেই ঋষি টলস্টয় কাউকে না জানিয়ে ‘আস্তাপভ’ স্টেশনের পাশে তুষার চাপা পড়ে মহামুক্তির দ্বারে পৌঁছে যান।

১৮.
টলস্টয় ছিলেন জমিদার, তার ছিল বিশাল জমিদারী। এসব সত্তেও তিনি ছিলেন জমিদার প্রথার ঘোর বিরুধী। শুধু তাই নয়, তার জমিদারীর বিশাল অংশ উনি দান করে দিতে চেয়েছিলেন, যা নিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে তার ছিল ঘোর বিবাদ। ভূমি সংস্কার নিয়ে টলস্টয়ের গভীর ভাবনা ছিল। উনিশ শ’ সাত সালে ভূমি সমস্যার সমাধান চেয়ে রুশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর মতো অভিজাত শ্রেণীর বাসিন্দা নেখলিউদভও স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিল ভূমির মায়া। নিজের বিপুল ব্যক্তিগত সম্পদের এক অংশ নামমাত্র খাজনায় দিয়ে দেয় কৃষকদের। বাকি সম্পত্তি বেচে দেয়। বিপ্লবের দিকে এগুচ্ছে তখন রাশিয়া। আর সে কারণে তথনকার বুদ্ধিজীবীদের প্রতি টলস্টয়ের প্রসন্নতা থাকার কোনো কারণ দেখি না আমরা। সেই অধ্যাপক, আমলা, চাকুরে উকিল, ডাক্তার, প্রকৌশলী প্রমুখ কারোরই দেশের সিংহভাগ জনগণের অর্থাৎ চাষিদের সম্পর্ক নেই। চাষিদের যে ভূমির মালিকানা থাকা দরকার সেটি বুদ্ধিজীবীদের কেউ বোঝেই না। টলস্টয়ের মতে, চাষিদের প্রত্যেকের একখন্ড জমি থাকা চাই, যা তাদের নিজেদেরই জমি, নিজেদেরই স্বত্বাধিকার। কিন্তু বিপ্লববাদী বুদ্ধিজীবীরা এইটুকু সুবিধাও তাদের দিতে চায় না। রাষ্ট্রের সব জমি রাষ্ট্রেরই মালিকানাধীন। এই বিপ্লবী চিন্তাও টলস্টয়ের মনঃপুত ছিল না।

১৯.
শোষিতের প্রতি টলস্টয় এর ছিল প্রচণ্ড মমত্ববোধ, ঠিক তেমনই শোষকের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড ঘৃণা। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যে সকল বিপ্লবী এই ভারতীয় উপমহাদেশে কাজ করত তাদের সাথে টলস্টয় এর যোগাযোগ ছিল। বাংলাদেশের অনেক বিপ্লবীর সাথেও টলস্টয় এর চিঠি পত্রের আদান-প্রদান ছিল। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। নিজে ছিলেন একসময় জার এর সৈনিক, পারদর্শীতা দেখাবার জন্য সাধারণ সৈনিক থেকে জেনারেল পদ-এ উন্নতি। এর পরও জার এর বিপক্ষে যে সব চেচেন এবং ককেশীয় বিপ্লবী কাজ করেছেন – তাদের নিয়ে তিনি নাটক-গল্প লিখেছেন – যেমন “হাজী মুরাদ”। হ্যা চেচেন বিদ্রোহী ইমাম শামিলের প্রধান শিষ্য “হাজী মুরাদকে” নিয়েই তিনি রচনা করেছিলেন এক অবিশ্বাসী গল্প। পাঠককে কি পরিচয়ে করিয়ে দেবো কে ছিল এই ইমাম শামিল ও হাজী মুরাদ? ক্রমাগত ৪৫ বছর পরাক্রমশালী রাশিয়ার জারের বিরুদ্ধে ইমাম শামিল সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিল যা এখনও পৃথিবীর ইতিহাসে আর কারো নেই গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্রে। এই জারের সৈনিক ছিল একসময় টলস্টয়। সেই টলস্টয় এর পক্ষে কিভাবে সম্ভব হোলো তারই এন্টি হাজী মুরাদকে নিয়ে গল্প লিখতে। নীতি ও আদর্শ এর জন্যই সেটা সম্ভব হয়েছে।

২০.
কোনো কেনো লেখকের স্বভাবে মিশে থাকে বিপ্লবের চেতনা। বিশেষ স্থানে ও কালে আবির্ভূত হয়ে তারা কোনো জননন্দিত বিপ্লবের প্রবক্তা ও ভাষ্যকার হয়ে ওঠেন। এই শ্রেণীর লেখকদের মধ্যে আছেন ম্যাক্সিম গোর্কি, ভদিমির মায়াকোভষ্কি, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ। রুশ বিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লব প্রসঙ্গে এই নামগুলো অপরিহার্য। অনেক সমালেঅচক অবশ্য বলেন, যুগজিৎ লেখক লিও টলস্টয় এদের পঙক্তিভুক্ত নন। বিপ্লবের পক্ষে তিনিও ছিলেন। কিন্তু বিপ্লবী চেতনা তার লেখকসত্তার কেন্দ্রে বিরাজ করেছে বলে মনে হয় না। তাহলে রুশ বিপ্লবের সঙ্গে টলস্টয়ের লেখাজোকার এবং জীবনদৃষ্টির সম্পর্ক কোথায়? বড় মাপের ব্যক্তিক্রমী ধাঁচের ভাবুকরা তাদের সময়ের (যে সময়ে তারা বেঁচে আছেন বা ছিলেন) চেয়ে অগ্রসর চিন্তা করে থাকেন। মোটমুটি স্পষ্টভাবেই ভবিষ্যত দেখতে পান তারা। দেখতে পেরেছিলেন টলস্টয়ও। এখানে লেনিনের একটি বক্তব্য প্রাসঙ্গিক হবে, ‘Lev Tolstoy as the mirror of the Russian Rovolution. Tolstoy is great as the spokesman of the ideas and sentiments of Russian peasants at the time the burgeoise revolution was approaching in Russia, Tolstoy, because of the sumtolal of this views, taken as a whole, happens to express the specific features of our revolution as a peasant burgeosie revolution.’ রুশ বিপ্লবের সঙ্গে টলস্টয়ের আত্মার যোগ ছিল গভীর। সেজন্য তার সিংহভাগ রচনায় আমরা দেখতে পাই রাশিয়ার কৃষক জীবনের অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ চিত্র। প্রগাঢ় সহানুভূতি এবং মমতার সঙ্গে তিনি এ চিত্র এঁকেছেন বারংবার। আর এ কাজ করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ার মতো উন্মোচিত হয়েছে অন্তসারশূন্য অভিজাত জীবনের কদর্য রূপ। বুর্জোয়াদের আক্রমণ করে উপন্যাস লিখেছেন অনেকেই।

২১.
রাশিয়ার গ্রামাঞ্চল সম্বন্ধে টলস্টয়ের ছিল গভীর বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান। ‘Tolstoy and the modern labour movement’ শিরোনামে লেনিনের একটি অসাধারণ প্রবন্ধ আছে। লেখাটির এক জায়গায় লেলিন বলেছেন, Tolsty had a surpassing knowledge of rural Russia, the mode of life of the land lords and peasants. In his artistic works he gave descriptions of this life that are numbered among the best works of world literature. সেই description’, বলার অপেক্ষা রাখে না, কৃষক জীবনেরই বয়ান। রাশিয়ার কৃষকদের দুঃখী জীবনে সুখের সুবাতাস বইয়ে দেবার উপায় সম্বন্ধে বিস্তর ভাবনা-চিন্তা করেছেন এবং কম-বেশি অসঙ্গতিও আছে। সেজন্য, ধারণা, যত না টলস্টয়ের ব্যক্তিসত্তা, তার চেয়ে বেশি দায়ী সেই যুগের চরিত্র।

২২.
রুশ বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দ্বন্দ্বমূলক বাস্তবতার দর্শন। সেই দর্শনের সঙ্গে টলস্টয়ের নৈতিক ভাবাদর্শের আপতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এসব ছাড়িয়ে তাঁর পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলার অভিপ্রায়টি বেশি ভাবায় আমাদের। এই স্বর্গরাজ্য সৃষ্টি সম্ভব, যদি মানুষ উদার ও নিঃস্বার্থ হতে পারে, যদি সে যাবতীয় লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগ করতে পারে। কিন্তু মানুষ কি তা পেরেছে? সুতরাং টলস্টয়ের ঐ অভীষ্ট পৃথিবী এক ইউটোপিয়া। চারপাশে বিরাজমান দেশবাস্তবতা এবং লেখকের আকাক্সক্ষার মধ্যকার ব্যবধানের বিষয়টিও তাকে ভাবিয়েছে বৈকি। সংশয়ে দুলেছেন তিনিও। আকস্মিক সঙ্কট পেরিয়ে টলস্টয় অবশেষে তাঁর মানসম্মত এক ধর্মে স্থির হয়েছিলেন যার মূল কথা বল প্রয়োগ নয়, অনাচারের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধ। এবং আত্মিক উন্নতির লক্ষ্যে শারীরিক শ্রম ও মানুষের জন্য কুণ্ঠাহীন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। যে ধরনের জীবন চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও অনুভূতি অনিবার্য করে তুলেছিল ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবকে, টলস্টয়ের কথাসাহিত্যে তার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি লক্ষণীয়।তবে আদর্শের আপোসহীনতা, বিশ্বাসের গভীরতা ও মানসিক দ্বন্দ্বের নিরিখে টলস্টয় নিঃসন্দেহে অনন্য এবং অতুল। তার কথাসাহিত্যে, বিশেষত প্রধান উপন্যাসসমূহে রুশ বিপ্লবের যে পদধ্বনি শুনতে পাওয়া গেছে যেভাবে ইঙ্গিত চিহ্নিত হয়ে উঠেছে কৃষিজীবী আর কারখানাজীবীদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন সেটাই তাকে পৌঁছে দিয়েছে অমামুলি উচ্চতায়। ঠিক এই জায়গাটাতে তার সমকক্ষ আর কেউ আছেন বলে মনে হয় না।

২৩.
এবার শোনা যাক 'জীবন কী' বলছেন টলস্টয়। আমার জীবনটা আসলে কী? পরিণত বয়সে পৌঁছে বিশ্বখ্যাত লেখক লিও টলস্টয় নিজেই নিজেকে এমন এক কঠিন প্রশ্ন করে বসলেন। হেতু? কারণ, ততদিনে তার মনে হয়েছে, এ হলো এমন এক প্রশ্ন যার সদুত্তর না মেলা পর্যন্ত লেখালেখি দূরে থাক, জীবনটাই হয়ে পড়ে অর্থহীন।পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ যার হাত ধরে বেঁচে থাকছে এবং তার তাবৎ শক্তি ও সামর্থ্য যার পেছনে বিনিয়োগ করছে তার নাম জীবন। এ জীবনকে তারা যেভাবে উপলব্ধি করছে তার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হচ্ছে তাদের সব কর্তব্য ও করণীয়। এ বোধ থেকে তারা স্থির করে, কোন বিষয়গুলো না হলেও ভালোই দিন চলে যাবে তার, আবার কোন বিষয়গুলো না হলে আক্ষরিক অর্থেই অচল হয়ে যাবে তার জীবন। শুধু কি তাই, পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যাবে বর্তমান জীবনের কোনো কোনো ঐশ্বর্য, সেগুলোও ঠিকঠাক করে দেয় জীবন সম্পর্কে তার এ অভিজ্ঞান।জীবন সম্পর্কিত মহাগুরুত্বপূর্ণ এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার শুরুতেই টলস্টয় তার 'জীবন সম্বন্ধে' গ্রন্থে জানিয়ে দেন, প্রতিটি মানুষ বেঁচে থাকে শুধু ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য, একান্ত তার নিজের ভালোর জন্য। একজন মানুষের কাছে বেঁচে থাকার অর্থ প্রতিমুহূর্তে সর্বোচ্চ ভালো থাকার কামনা লালন করে চলা এবং পর্যায়ক্রমে সেই লক্ষ্যকে ছুঁয়ে দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে আমার প্রশ্ন করতে পারি, কিসে একজন মানুষের উত্তম নিহিত? সে কি জানে না তার সব আনন্দই ক্ষণস্থায়ী এবং তার নিজের কাছে সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ_ সেই ব্যক্তিত্বেরই অবধারিত পরিণতি হচ্ছে দুর্ভোগ এবং মৃত্যু! অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে এ ব্যক্তিত্বের বাইরে অস্তিমান যে জীবন, একমাত্র তা-ই স্থায়ী। যদিও অধিকাংশ মানুষের কাছে তার ব্যক্তিগত চাওয়ার সাপেক্ষে এ 'বহিঃস্থ জীবন' স্রেফ অর্থহীন এক উচ্চারণ, যা আদৌ তার কাছে কোনো আবেদন বহন করে না।অতএব একজন মানুষ যে জীবনকে তার একমাত্র জীবন বিবেচনা করে এবং স্থির বিশ্বাসে তাকে যাপন করে চলে, প্রকৃত অর্থে তা অলীক এবং অসম্ভব। বরং তার 'বিখ্যাত' ব্যক্তিত্বের বাইরে অস্তিমান জীবন_ যাকে সে জানে না, অনুভব করে না এবং ভালোবাসে না_ সেটাই তার প্রকৃত জীবন।'টলস্টয় গভীরভাবে লক্ষ্য করেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় গুরুগণ বিরতিহীনভাবে মানুষকে বলে বেড়ান পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব আর এর বিপরীতে ধর্মীয় আচারাদি পালনসাপেক্ষে মৃত্যু পরবর্তী উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতির কথা, অথচ অধিকাংশ মানুষ কদ্যপি তাদের বিশ্বাস করে না। তাদের এ অবিশ্বাসের অন্যতম কারণ, খোদ ধর্মগুরু কিংবা পেশাজীবী ধর্মাত্মারা পার্থিব আনন্দ বর্জনের পরিবর্তে বরং আরও বেশি করে তা অর্জনের লক্ষ্যেই অধিক সচেষ্ট থাকেন। তারা ডুবে থাকেন আরও বেশি ক্ষমতা, আরও বেশি বিনোদনের লক্ষ্যে অবিরাম এক খেয়োখেয়ির মধ্যে। পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে এখানে, ইহলোকে একজন মানুষের যাপিত জীবন যদি অর্থহীনই হয়, সেক্ষেত্রে কোন যুক্তিতে অর্থপূর্ণ হতে পারে পরকালে তার যাপিতব্য জীবন?প্রচলিত বিজ্ঞান আমাদের শেখায় দেহকোষের কার্যকলাপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত থাকে মানবজীবন। বিজ্ঞান এসব কোষের কার্যকলাপের ব্যাখ্যা সন্ধান করে। অথচ এটাই সত্য, ভালোর লক্ষ্যে নিবেদিত মানুষের বাস্তব জীবনের রহস্য উদ্ঘাটনে সে পুরোপুরি অক্ষম।'এবং আমাদের বেঁচে থাকতেই হবে। যাপন করে যেতে হবে এ জীবন। কিন্তু কী সেই জীবন? প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠা এবং ঘুমুতে যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে কৃত অজস্র কার্যকলাপের সমষ্টিই জীবন। প্রতি মুহূর্তে আমাকে যেতে হচ্ছে এক ধরনের বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সম্ভাব্য আরও এক শো কাজের মধ্য থেকে বেছে নিতে হচ্ছে আমার কাজটি। কিন্তু আমার পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কীভাবে সম্ভব যখন আমি নিজেই জানি না কোনটি আমার জন্য ভালো আর কোনটি খারাপ।'সারাজীবন আঁতিপাতি করে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরেছেন টলস্টয়। ধ্রুপদী দার্শনিক আর কাব্বালাদের লেখাপড়ার জন্য শিখেছেন গ্রিক এবং হিব্রু। জীবনের সংজ্ঞা জেনেছেন কনফুসিয়াস আর লাও জি, ভারতীয় বেদ, বুদ্ধের বাণী, ইহুদি ঋষি এবং যিশুখ্রিস্টের কাছ থেকে। অবশ্য সবার মাঝে খ্রিস্টের সংজ্ঞাটাই তার কাছে মনে হয়েছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। অন্য সমস্ত সংজ্ঞাই একাকার হয়ে যায় তার এ উপলব্ধির কাছে এসে যে, জীবন হচ্ছে ঈশ্বরপ্রেম এবং তোমার প্রতিবেশীর প্রতি প্রেম। যা কিছু ভালো তা অন্যের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই নিহিত জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য।'ঈশ্বর' বিষয়ক ধারণায় পৌঁছাতে গিয়ে টলস্টয় উপলব্ধি করেছেন চৈতন্যের স্বরূপ। এ উৎস চেতনাকেই তার মনে হয়েছে মানবজীবনের প্রকৃত সার। তার মনে হয়েছে মানবজীবন আর ইতর প্রাণীর জীবন এক নয়। এ শুধু জীবনের প্রকাশ, এর উপরিকাঠামো। দৈহিক জন্ম কিংবা মৃত্যুর সঙ্গে এ জীবন শেষ হয়ে যায় না। বরং জীবন হচ্ছে বিচিত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে চৈতন্যের এক অবিরাম প্রবাহ। প্রতি মুহূর্তে যা এক রূপ থেকে বদলে জন্ম নিচ্ছে আরেক রূপে। 'মানুষ যতই চেষ্টা করুক কখনোই সে জানতে পারবে না কোথা থেকে তার শুরু,' জানান টলস্টয়। এ কথার অর্থ, চৈতন্য অবস্থান করে এমন এক অবস্থানে যা সময়েরও অগম্য।টলস্টয়ের দর্শন অনুসারে ঈশ্বরকে বুঝতে হবে সময়হীন সীমাহীন এক চৈতন্য হিসেবে। এর মধ্যেই পাওয়া যাবে জীবনের অর্থ। মানুষ যখন তার নিজের জীবনে আবিষ্কার করে এই চৈতন্য, সে তখনই উপলব্ধি করে তার নিজের ভেতরকার ঈশ্বর। এই চৈতন্য, ঈশ্বর, মূলত অখণ্ড। চেতন মানুষ কখনোই বুঝতে পারে না কোথা থেকে সে এলো। বরং সে উপলব্ধি করে বিচিত্র যত চেতনাপ্রবাহের মধ্যে মিশে থাকা তার নিজের চৈতন্য, যা তার একমাত্র জীবন।অথচ শর্তসাপেক্ষ ছাড়া ব্যক্তিকে খণ্ডরূপে বিচার অসম্ভব। বোধগম্য, ব্যক্তিগত ভালোত্ব এক অলীক ধারণা। আমরা যদি নিজেদের ভালো প্রথমে চাই এবং তারপর অন্যের কাছ থেকে এমন ভালো আশা করি যা আমাদেরই মঙ্গল সাধন করবে_ এই চাওয়া অসম্ভব। কেননা, এ যুক্তি অনুসারে প্রতিটি মানুষ প্রথমত তার নিজের ভালোর কথাই চিন্তা করবে। এখান থেকে এ বিষয়টি অন্তত পরিষ্কার যে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে, শুধু নিজের ভালো চাওয়ার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক ভালোর উৎপাদন অসম্ভব।এর ঠিক বিপরীত এক পরিস্থিতির জন্ম হয় যখন মানুষ এই বৃহৎ ঐক্য এবং চেতনার অবাধ প্রবাহের মধ্যে আবিষ্কার করে তার নিজের স্বরূপ। এক্ষেত্রে একজন মানুষ তার নিজের মঙ্গলকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজেকে বিনিয়োগ করে অন্যের ভালো সাধনের নিমিত্তে। এখন, এই মানুষটি আশা করতেই পারে তার দেখাদেখি অন্য মানুষটিও একই কাজে উৎসাহিত হবে। আর এমন কিছু হলে তা হবে সামগ্রিক মানবজাতির জন্যই কল্যাণকর। অন্য কারও মঙ্গলের লক্ষ্যে নিজের চাওয়াগুলো বিসর্জন দেওয়ার অর্থই হচ্ছে আমি তার মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছি এবং তাকেই ভালোবেসেছি। খ্রিস্টের মতে, এই প্রেম ভালোকে নিশ্চিত করে। এই প্রেমের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা অর্জন করে মানবজীবন। যুক্তিটি নিতান্তই সরল এবং বোধগম্য। মানবেতিহাস এমন অজস্র মানুষ পেয়েছে যারা এ উপলব্ধিকে নিয়মিত চর্চা করে গেছেন তাদের প্রাত্যহিক জীবনে। টলস্টয়ের বিশ্বাস ছিল, অধিকাংশ মানুষ শিগগিরই তাদের প্রাণীচৈতন্য থেকে জেগে উঠে এই সত্য আবিষ্কার করবে এবং হয়ে উঠবে প্রকৃত মানুষ। আর তা ঘটলে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ সেদিন সবেগে ধাবিত হবে এক মহাউত্তরণের লক্ষ্যে।এসব গ্রন্থ টলস্টয় রচনা করে গেছেন আজ থেকে একশ বছর আগে। অথচ বর্তমান শতকে এসেও আমরা দেখছি অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে তার অনেক ভবিষ্যদ্বাণী। টলস্টয় পরবর্তী এই গোটা সময়টা মানুষ অন্ধের মতো নিজেকে নিরত রেখেছে যুদ্ধ আর সংঘাতের মাঝে। ব্যক্তিগত চাহিদা চারিতার্থ করতে গিয়ে বাসঅযোগ্য করে তুলেছে পৃথিবীটাকে। তবু শেষ হয়নি তাদের দুর্নিবার যুদ্ধাকাঙ্ক্ষা। কেন এমন হলো? কেন তারা ব্যর্থ হলো টলস্টয়ের প্রত্যাশা পূরণে? এ সম্পর্কেও বলে গেছেন তিনি নিজেই। একজন মানুষ কখন, জীবন কী, এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়? প্রাণিসত্তা থেকে যখন তার উত্তরণ ঘটে এবং সে উপনীত হয় মানবচৈতন্যের স্তরে একমাত্র তখনই তার মধ্যে জন্ম হয় এ প্রশ্নের, জীবন কী? এটি ঘটার পর আর কোনোভাবেই সে ফিরে যেতে পারে না তার পূর্ববর্তী স্তরে। নতুন এ উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু ঘটে তার পূর্ববর্তী চৈতন্যের। যেমন, বীজ থেকে নতুন চারার প্রস্ফুটনের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় বীজের সমগ্র জীবন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠে নতুন চারাটি। কিন্তু তবুও মানুষ সহজে ভুলে যেতে পারে না তার শিকড়। নিজেকে সে শক্ত এক বাঁধনে বেঁধে রাখতে চায় বিচ্ছিন্ন সেই সত্তার সঙ্গে। তার ভয় হয়, এই বিশ্বাস হারিয়ে গেলে সে হয়ে পড়বে অবলম্বনহীন। নিজেকে রক্ষার প্রাণিজ প্রবৃত্তি তাকে তাড়িত করে এ কাজ করার জন্য। একমাত্র এ কারণেই সে তার পূর্বপুরুষের এসব অর্জনকে দেখে সন্দেহের চোখে। যদি তাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে তার জন্য, তখন সে তাদের পাগল বলে উপহাস করে। কখনও অপরাধী বিবেচনায় তাকে নিক্ষেপ করে কঠিন শাস্তির মধ্যে। নিষ্ঠুর এ নিয়তি এড়াতে পারেননি এমনকি টলস্টয়। যদিও তিনি ছিলেন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তার বক্তব্য শুনে রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চ তাকে বহিষ্কার করে। প্রবীণ বয়সে রচিত তার সবচেয়ে প্রাজ্ঞ লেখাগুলো ব্যর্থ হয় মানুষের আদর কুড়াতে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, বহু দশক ধরে খোদ রাশিয়ায় তাকে দেখা হতো অদ্ভুত এবং অবাস্তব ধারণা লালনকারী স্ববিরোধী এক বিচিত্র চরিত্র হিসেবে। মানুষের সঙ্গে ধর্ম, বিজ্ঞান এবং সমাজের সম্পর্ক নিয়ে নিজের মতাদর্শ উদ্ঘাটন করেছেন টলস্টয়। চৈতন্যের যে স্তরে আমাদের যাবতীয় ভোগান্তি তা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দেখিয়েছেন সেই পথ যার মধ্যে নিহিত রয়েছে সর্বপ্রাণীর মঙ্গল। নিজের প্রতি সততাবশত টলস্টয় তার প্রাত্যহিক জীবনে সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন যা তিনি প্রচার করেছেন অপরের উদ্দেশে ন্যূনতম জাগতিক চাহিদা, নিজের সেবা এবং জীবনের প্রধান যে লক্ষ্য- সেই ভালোবাসার সেবা করে চলা। এক কথায়, ভালোবাসা বেঁচে থাকে ভবিষ্যৎ নয়, আজকের এ মুহূর্তটির মধ্যে, এক মুহূর্তের কাজের মধ্যেই তার চিরকালীন বসবাস।’ (অনুবাদ :মিলটন মোল্লা)।

২৪.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক, প্রাবন্ধিক আহমদ কবির ‘টলস্টয়, অন্নদাশঙ্কর রায়’ রচনায় সুন্দর করে লিখেছেন, ‘রুশ ভাষার জগৎবিখ্যাত লেখক লিও টলস্টয়ের (১৮২৮-১৯১০) রচনা এ কালের তরুণ পাঠকের কতখানি পঠিত সেটি ভেবে নেয়া খুব দুষ্কর নয়। একুশ শতকের উচ্চ প্রযুক্তি, নববিজ্ঞান, বাণিজ্য, উন্নয়ন, নির্মাণ, প্রবৃদ্ধি, পরিকল্পনা, বাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের তীব্র ব্যস্ততা ও প্রতিযোগিতার কালে সাহিত্য পাঠের পরিসর যে ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে, তা তো বোঝাই যায়। কিন্তু সময় যত পাল্টাক কিংবা দ্রুতগামী হোক না কেন, মনোজ্ঞ সাহিত্য পাঠক সব সময় থাকে, এ কালেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে, সংখ্যায় কম হয়ে গেলেও। কেবল স্বভাষার সাহিত্য নয়, বিদেশি ভাষার সাহিত্য ও পাঠকের চিত্তলোকে রসানুভূতির বীজ বপন করে। কিন্তু শুধু রসের জন্য নয়, জীবনের জন্য সাহিত্যের প্রয়োজন কোনোদিন ফুরাবে না।অথচ একসময় আমাদের দেশে তরুণ সাহিত্যমোদীদের রুচি, প্রগতি ও সমাজ রূপান্তর প্রশ্নে রুশ সাহিত্যই ছিল প্রণোদনা। প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালের কল্লোল, কালি-কলম, পরিচয় ইত্যাদি পত্রিকার লেখকরা নবসাহিত্য-সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে রুশ সাহিত্যকে গ্রহণ করেছিলেন দু'হাতে। কল্লোল যুগের লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ও রুশ সাহিত্যে প্রাণিত হয়েছিলেন, বিশেষ করে টলস্টয়ের রচনা ও সাহিত্যাদর্শ তাকে বিমুগ্ধ করেছিল। … গত শতাব্দীর প্রথমাংশে রুশ বিপ্লব (১৯১৭) সফল হওয়ার পরে রুশ সাহিত্যের ব্যাপক পরিচিতি ঘটতে শুরু করে। যদিও রুশ সাহিত্য আগে থেকেই সমৃদ্ধ। বিপ্লবী শাসকরা সোশ্যালিস্ট রিয়েলিজম অর্থাৎ 'সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা'র নতুন শিল্প ও সাহিত্যনীতির কাঁচি দিয়ে বিপ্লব-পূর্ব সাহিত্যকে ছাঁটাই করে দেননি, বরং রেখে দিয়েছেন উত্তর পাঠকের জন্য, যারা ওগুলোতে পাবে মহান মানবতা, সমাজ জিজ্ঞাসা ও শিল্পরীতির উন্নত রূপ।’

(তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, লিয়েফ তলস্তোয়: হায়াৎ মামুদ, টলস্টয়: অন্নদাশঙ্কর রায়, শিল্পের স্বরূপ: দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ অনুদিত, টলস্টয়: বাংলাদেশ আফ্রো- ইউনিয়ন সংস্হা, দৈনিক সমকাল, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত