প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মাও সে তুং

মতাদর্শিক একজন মানুষ হন পাহাড়ের মতো অটল আর ব্যক্তি মানুষ যেন পেঁজা তুলোর মত হালকা– মাও সে তুং

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৫০

১.
মাও সে তুং (মাও জে দং) চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবের নেতা ও প্রাণপুরুষ হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন আমৃত্যু। সেদেশে সমাজতন্ত্রের সাম্য প্রতিষ্ঠায় তার অবদান চিরস্মরণীয়। মাও সে তুং- কবি, সংস্কারক, শাসক, সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার মতো গুণাবলি তাকে যেমন ইতিহাস বিশিষ্ট স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে, তেমনি তিনি বিশ্বের অনেকের কাছেই আবার একনায়ক হিসেবেও পরিচিত হয়েছেন। বিশ্বব্যাপী তিনি চেয়ারম্যান মাও নামে খ্যাত হন। পৃথিবী কাঁপানো বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব মাও সে তুং ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াণ দিনে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। যদিও মাওকে নিয়ে লিখতে বসে মনে পড়ছে আমার পরিচিত বেশ কয়েকজনের কথাও, মতামত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে প্রবলভাবে ছিলেন বলেই মাও সে তুং-কে অতটা পছন্দ করেন না তারা কিন্তু আবার মাওবাদের গুরুত্বকেও অস্বীকার করেন না, করা যায় না বলেই। আমি সরকার ও রাজনীতির ছাত্র বলে মাওবাদের পাঠ নিতে হয়েছে, আবার এখন দিতেও হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সফল লং মার্চ করেছিলেন মাও সে তুং।আর তারই অনুসরণে স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম লংমার্চ করেছিলেন মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। 

২.
"আমরা কমিউনিস্টরা হচ্ছি বীজের মতো, জনগণ হচ্ছেন জমির মতো। আমরা যেখানেই যাই না কেন, সেখানকার জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে, জনগণের মধ্যে শিকড় গাড়তে এবং প্রস্ফুটিত হতে হবে।" - মাও সে তুং
মাও সে তুং (জন্ম : ২৬ ডিসেম্বর, ১৮৯৩ - মৃত্যু : ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬) চীনা বিপ্লবী মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক নেতা। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। ১৯৪৯ সালে চীনের শাসন ক্ষমতায় আসেন ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য এক দূরদর্শী কর্ণধার মাও সে তুং। তার নেতৃত্বেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসে এবং পরবর্তী সময়ে এ বিশাল দেশটির মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের চাকা ঘুরতে শুরু করে। শাসন ক্ষমতায় এসেই মাও ওই বছরেরই ১ অক্টোবর দেশটিকে ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’ বলে ঘোষণা করেন। মাও সে তুং ছিলেন এই পার্টির প্রথম চেয়ারম্যান। ১৯৪৯ সালে সমাজতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চীন শাসন করেন। তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদে তার তাত্ত্বিক অবদান, সমর কৌশল এবং তার কমিউনিজমের নীতি এখন একত্রে মাওবাদ নামে পরিচিত। শাসনকালে তিনি চীনকে একদলীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত করেন। তিনি চীনের শিল্পকারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনেন। ‘মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় তিনি নিজের তত্ত্বও কাজে লাগান। প্রচলিত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তিনি একজন নাস্তিক ছিলেন। 

৩.
"আমরা মার্কসবাদী, মার্কসবাদ আমাদের শিক্ষা দেয় যে, কোনো সমস্যার বিচার করতে গেলে, বির্মূত সংজ্ঞা থেকে নয়, বরং বাস্তবে বিদ্যমান তথ্য থেকে শুরু করতে হবে, এই সব তথ্যের বিশ্লেষণ থেকেই কর্মনীতি, নীতি এবং উপায় খুঁজে বের করতে হবে।" - মাও সে তুং
মাও সে তুং ১৮৯৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর চীনের হুনান প্রদেশের শাং তান জেলার শাউ শাং চুং গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাও সে-তুং-এর বাবার নাম ছিল মাও জেন শেং (শুন সেন)। শুন শেং দরিদ্র কৃষক হলেও কয়েক বছর সেনাবাহিনীতে চাকরি করে জমিজমা ক্রয় করে অবস্থার উন্নতি করেন এবং কাঁচামালের ব্যবসা করে রীতিমত মধ্যবিত্ত গৃহস্থ হয়ে ওঠেন। মাওয়ের অন্য দুই ভাইয়ের নাম ছিল সে সেন ও সে তান। মাওয়ের মা ছিলেন শিয়াং শিয়াং জেলার তং শিয়াতো গ্রামের বেন পরিবারের মেয়ে। তিনি ছিলেন দয়ালু। মা ওয়েন চি মেই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুরক্ত একজন ধর্মপরায়ণ মহিলা। ওয়েন চেয়েছিলেন, ছেলেও যেন তাঁর মতোই ধর্মের পথে বিকশিত হন। আর সে কারণেই মাওকে পারিবারিক ও ধর্মীয় কঠোর অনুশাসনের মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়েছে। ২৫ বছর বয়সের আগে একা একা বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। মাওয়ের বয়স যখন মাত্র সাত তখন থেকে খেতখামারের কাজে লেগে যান। ১৯০১ সালে আট বছর বয়সে মাও গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হন। এবং তেরো বছর বয়স পর্যন্ত ঐ পাঠশালাতে লেখাপড়া করেন। ১৯০৬ সালে মাওয়ের গ্রামের পড়াশোনা শেষ হয়। 

৪.
"শ্রেণী সংগ্রাম - কতকগুলো শ্রেণী জয়লাভ করে, আর কতকগুলো বা ধ্বংস হয়। এটাই ইতিহাস, এটাই হাজার হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, এই দৃষ্টিকোণের বিপক্ষে দাঁড়ানোই হচ্ছে ঐতিহাসিক ভাববাদ।" - মাও সে তুং
১৯১১ সালে মাওয়ের বয়স যখন ১৮, তখন চীনে জীর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত চিং রাজবংশের বিরুদ্ধে বিপ্লব সংগঠিত হতে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে সমগ্র চীন শাসন করে আসা সেই রাজবংশ ১৯১১ সালের বিপ্লবের মুখে আর টিকে থাকতে পারেনি। বিপ্লব শুরুর অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই পতন ঘটে যায় তাদের। তরুণ বয়সেই মাও রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে বামপন্থী রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। মার্কসবাদের প্রতি প্রবলমাত্রায় আকর্ষণ ছিল তাঁর। ১৯২০ সালের দিকে তিনি একজন মার্কসবাদী হিসেবে চীনা রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেন। ১৯২১ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠায় যদিও তাঁর ভূমিকা ছিল অন্যতম। কিন্তু পার্টির নেতৃত্বে পৌঁছানোর জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল দীর্ঘ সময়। অবশেষে ১৯৩৫ সালে মাও যখন কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গেলেন, তারপর থেকে রাজনীতির মাঠে পার্টির ক্ষমতা ও কার্যকর ভূমিকা বাড়তে শুরু করে এক অদম্য গতিতে।

৫.
"বিপ্লব কোনো ভোজ-সভা নয় বা প্রবন্ধ রচনা বা চিত্র অংকন কিংবা সূচীকর্ম নয়; এটা এত সুমার্জিত, এত ধীর-স্থির ও সুশীল, এত নম্র, দয়ালু, বিনীত, সংযত ও উদার হতে পারে না।বিপ্লব হচ্ছে বিদ্রোহ - উগ্র বলপ্রয়োগের কাজ, যার দ্বারা এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে পাল্টে দেয়।"- মাও সে তুং। 
পিকিং ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার সময় তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। কাছাকাছি সময়েই তিনি চীনে ভূমি সংস্কারের আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা পালন করেন। রেড আর্মি প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর ছিল প্রধান ভূমিকা। চীনের গৃহযুদ্ধ অবসানেও তাঁর অবদান অনেক। ১৯৪৭ সালের মধ্যে চিয়াং কাই শেকের নেতৃত্বাধীন চীনের জাতীয়তাবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সার্বিক সংগ্রামের প্রস্তুত নিতে শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না। দুর্দান্ত প্রতাপের সঙ্গে সংগ্রাম পরিচালনা করে মাও সে তুং ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্টদের নিয়ে এলেন চীনের মাটিতে। চীনের শাসন ব্যবস্থায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো তাদের। বিজয়ের মাধ্যমে চীনকে তিনি নিয়ে যেতে সক্ষম হন আধুনিক দেশের কাতারে। ১৯৪৯ সালে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। একই সময় কমিউনিস্ট পার্টিকে একমাত্র দল হিসেবে বাস্তবায়ন করেন। ভূমি সংস্কারের কাজে তাঁকে শক্তিশালী বিরোধিতার মুখে পড়তে হয় ভূস্বামীদের। কিন্তু নিজ দক্ষতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে এ ক্ষেত্রেও তিনি সফল হন। কিছু ক্ষেত্রে তাঁকে বিতর্কিত করা হলেও তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা প্রসারের মতো আরো কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে চীনকে এক সময় পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শক্তিতে পরিণত করেন। 

৬.
মাও যখন চীনের ক্ষমতায় আসেন তখন সমগ্র বিশ্বে চীনের পরিচয় ছিল একটি অনুন্নত ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশ হিসেবে। বিগত সময়ের যুদ্ধ-বিগ্রহে চীন তখন ক্ষত-বিক্ষতপ্রায়। পুঁজিবাদী ভগ্নপ্রায় চীনকে নতুনভাবে মাও সে তুং নির্মাণ করতে শুরু করলেন সমাজতন্ত্রের আদর্শে। যদিও এ কারণে চীনে তিনি তখন রাজনৈতিকভাবে একটি কঠোর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু তার পরও মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বেই চীন উত্তরণের পথে হাঁটতে শুরু করল। চীনের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব সংগঠিত করার পাশাপাশি সামাজিক বিপ্লব ঘটানোরও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চীনের উন্নয়নের ব্যাপারে মাওয়ের সব সিদ্ধান্তই সফলভাবে কার্যকর হয়নি। ১৯৫৮ সালের দিকে মাও চীনে যে কর্মসূচি চালু করেছিলেন সে পরিকল্পনাটি সফল হতে পারেনি। পরবর্তী মাও ১৯৬৬ সালের দিকে অনেক কমিউনিস্ট নেতার বিরোধিতাকে উপেক্ষা করেই সাংস্কৃতিক বিপ্লব নামে আরেকটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। এ পরিকল্পনার কারণে তখন চীনের কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থায় এক রকম দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে শুরু করে। তবে এসব কোনো কিছুই মাওকে তাঁর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন থেকে হটাতে পারেনি। মাও তাঁর কিছু একান্ত অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন আর অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির কিছু আমলা তৎকালীন সময়ে তাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ১৯৬৮ সালের দিকে এ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। যদিও নবম কংগ্রেস, ১৯৬৯ সালে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব অব্যাহত রাখে আর দেখায় যে সিপিসি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সে-তুঙ চিন্তাধারা দ্বারা পরিচালিত। এভাবে এ পর্যন্ত এটা অগ্রসর হয়।

৭.
প্রথম জীবনে মাও সে তুং বিশ্বাস করতেন, শহরে শিল্প-কারখানার শ্রমিকরাই হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর এ ধারণা অনুযায়ী চীনের উন্নয়নের পথে তিনি অগ্রসর হননি। মার্কসবাদী এই দর্শনকে টপকে ১৯৫২ সালের দিকে মাও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার প্রধান সমর্থন তিনি চীনের সাধারণ কৃষকসমাজ থেকেই আদায় করবেন। জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার দীর্ঘ লড়াইয়ের সময় পার্টির ক্ষমতার প্রধান ভিত্তিই ছিল চীনের গ্রামাঞ্চলে, সে কথা ভুলে যাননি মাও। চীনের কৃষিজীবী মানুষকে প্রাধান্য দিয়েই তিনি পার্টির শাসন ব্যবস্থার নীতিনির্ধারণ করেছিলেন। মাওয়ের রাষ্ট্রনীতি চীনকে বদলে দিয়েছিল। দেশটির সর্বজনীন আধুনিকায়ন, দ্রুতগতিতে শিল্পায়ন এবং গণশিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতিতে মাও সে তুং বিশাল অবদান রেখেছেন নিঃসন্দেহে। 

৮.
বিপ্লবী অমর নেতা মাও সেতুংয়ের ব্যক্তিগত জীবনকে দারুণ বৈচিত্র্যে ভরা বলা চলে। তিনি যখন যুবক, তখনই মাও-এর বাবা তাকে সৈন্য দলে ভর্তি করানোটাকে লাভজনক মনে করেন। তার আগেই মাওয়ের সঙ্গে এগারো-বারো বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে মাও সেতুং এ-বিষয়ে লিখেছিলেন, 'এটা ছিল একেবারে নামমাত্র বিয়ে। আমি কখনোই তার সঙ্গে বসবাস করিনি এবং তাকে আমার স্ত্রী বলেও মনে করিনি।' এর বাইরে মাও সেতুংয়ের জীবনে নারীদের আনাগোনা ছিল ভালোই। মাও সেতুংয়ের চার স্ত্রী আর তাদের মোট সন্তানের সংখ্যা ছিল ১০ জন। তারা হলেন লুও ইক্সিউ [২০ অক্টোবর, ১৮৮৯-১৯১০] তাদের বৈবাহিক জীবন ছিল ১৯০৭ থেকে ১৯১০ পর্যন্ত। দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়াং কাইহুই [১৯০১-১৯৩০]। তার সঙ্গে সংসার হয় ১৯২১ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত। পরেরজন ছিলেন হে জিঝেন [১৯১০-১৯৮৪]। বৈবাহিক জীবনের ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কাটে তার সঙ্গে। আর সর্বশেষ জনের নাম চিয়াং চিং [১৯১৪-১৯৯১]। ১৯৩৯ থেকে মাও-এর মৃত্যু পর্যন্ত মাও সেতুংয়ের সঙ্গী ছিলেন তিনি। এর মধ্যে দুই স্ত্রীর সঙ্গেই মাও সেতুংয়ের প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক বিয়েতে রূপ নেয় বলে মনে করা হয়। দুরারোগ্য পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে চীনের বেইজিংয়ে ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছেড়ে যান তিনি।

৯.
মাও কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠেন বটে কিন্তু চীনা ক্লাসিক সাহিত্যকে ভালোবেসে এবং সেই সময়ে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে উঠতে পেরেছিল সংস্কৃতির ব্যাপারেও। ‘শিল্প-সাহিত্যে এবং বিজ্ঞানে ভুল এবং সঠিকতার প্রশ্নটি শৈল্পিক এবং বৈজ্ঞানিক পর্যায়বৃত্তিক মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে স্থির করা যেতে পারে,’ তিনি লেখেছিলেন, সারমর্মের ঢঙে এগুলো নির্দিষ্ট হতে পারে না। তিনি প্রায়ই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করতেন শিল্পীদের কৃষক এবং প্রলেতারিয়েতের শ্রেণীস্বার্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে, এ সময় তিনি তৈরি করে নেবেন নিজস্ব একটি রচনাশৈলী। যদিও চেয়ারম্যান মাও ছিলেন বৈপরীত্যে ভরপুর একজন মানুষ- একজন জাতীয়তাবাদী, কমিউনিস্ট, বিপ্লবী, যোদ্ধা, লাল বইয়ের প্রণেতা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কয়েক দশকব্যাপী সর্বোচ্চ নেতা। কিন্তু এসব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি একজন কবি। চীনের বিংশ শতাব্দীর অগ্রগণ্য কবিদের একজনও বটে। তার সৃষ্টিকর্মের একটি নতুন অনুবাদ তাকে শিল্পী হিসেবে মূল্যায়ন করার দ্বার খুলে দেয়। একজন সমালোচক ওয়াশিংটন পোস্টে মাও এর কবিতাকে ‘রাজনৈতিক দলিল’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘সাহিত্য হিসেবে এটা মর্যাদার দাবি রাখে।’ সাহিত্য থেকে রাজনীতিকে অবশ্য বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। ‘প্রথম ঘেরাও’ এর সময় মাও লেখেন, ‘দশ লক্ষ শ্রমিক এবং কৃষককে আমরা দিয়েছি জাগিয়ে’।

১০.
পাকিস্তানের সরকারের গোপন সহযোগিতায় ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন হাত মেলালেন চীনের নেতা মাও সে তুং-এর সাথে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে যে পারষ্পরিক অবিশ্বাস এবং শত্রুতা চলছিল তার অবসান ঘটলো। দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতার প্রতীক এই সফরকে একটি কূটনৈতিক বিজয় বলে মনে করা হয়। মি. নিক্সন পরে মন্তব্য করেন, ''সফরটি বদলে দিয়েছে বিশ্বকে।" কোনো কোনো চীন বিশেষজ্ঞ বলেন, গত শতকের মধ্যভাগের ইতালির রাজনৈতিক নেতা মুসোলিনী প্রথমে সোশ্যালিস্ট থাকলেও দ্রুত সোশ্যালিষ্ট থেকে ফ্যাসিস্ট নেতায় রূপান্তরিত হন। তাঁর স্বপ্ন ছিল অতীতের রোমান সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার। তেমনি নয়া চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং মতবাদে সমাজতন্ত্রী হলেও মনোভাবে ছিলেন প্রাচীন চীনের বিশাল সাম্রাজ্যের অনুরাগী এবং সেই সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের স্বাপি্নক। শেষ জীবনে চেয়ারম্যান মাওয়ের অফিসকক্ষের দেয়ালজুড়ে শোভা পেত প্রাচীন যুগের চীন সাম্রাজ্যের বিশাল মানচিত্র।

১১.
মাওবাদ কী? মাওবাদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগ্রামে, সমাজতন্ত্রের বিকাশে এবং সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব আকারে সর্বহারা একনায়কত্বধীনে বিপ্লবকে অব্যাহত রাখা যখন সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস গভীরতর হয় আর ইতিহাসে বিপ্লবই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান প্রবণতা, সেই সময়কালের জটিলতম ও বিরাটতম যুদ্ধসমূহ ও সমকালীন সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে অপ্রশম্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ-লেলিনবাদের একটি নতুন, তৃতীয় ও উন্নত স্তরে বিকাশ। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সেই বিকাশই হচ্ছে মাওবাদ। এই মাওবাদকেই মাও সে-তুঙ-এর নেতৃত্বাধীন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) “মাও সে-তুঙচিন্তাধারা” হিসেবে সূত্রবদ্ধ ও প্রচার করতো। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সর্বহারাশ্রেণীও মাও সে-তুঙ চিন্তাধারা বলতো। তবে মাও-এর মৃত্যুর পর চতুর্থ আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সর্বহারাশ্রেণীর প্রস্তুতি সংগঠন- “বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন” (আর.আই.এম.) ১৯৯৩ সালের বর্ধিত সম্মেলনে “মাও সে-তুঙ চিন্তাধারা” পরিবর্তন ক’রে “মাওবাদ” সূত্রবদ্ধ করে। তারপর থেকে আর.আই.এম-এর বাইরেও মাও সে-তুঙ চিন্তাধারা অনুসারী পার্টি ও সংগঠনসমূহ “মাওবাদ” সূত্রায়ন গ্রহণ করতে থাকে। মাও সে-তুং চিন্তাধারাকে মাওবাদ বলাটা শুধুমাত্র সূত্রায়নের পরিবর্তন নয়। এভাবে সূত্রায়ন সর্বহারাশ্রেণীর মতবাদের তৃতীয় স্তর সম্পর্কে (প্রথম স্তর মার্কসবাদ, দ্বিতীয় স্তর লেনিনবাদ) উচ্চতর উপলব্ধিকে প্রকাশ করে। যার সাথে কমরেড স্ট্যালিন সম্পর্কে মাও-এর সারসংকলন, মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় লিউশাওচী-লিন পিয়াও-তেং শিয়াও পিং বিরোধী সংগ্রামের শিক্ষা এবং মাও-মৃত্যু পরবর্তীকালে গণযুদ্ধ সম্পর্কে মাওবাদীদের উচ্চতর উপলব্ধি অর্থাৎ, গণযুদ্ধের সার্বজনীনতা সম্পর্কিত। এসব না বুঝলে মাওবাদ সম্পর্কে উপলব্ধির ঘাটতি থেকে যাবে। অনুশীলনে দেখা গেছে মাও চিন্তাধারা ও মাওবাদের সাথে সারবস্তুগতভাবে পার্থক্য না থাকা সত্ত্বেও এই উচ্চতর উপলব্ধির ভিত্তিতে যারা মাওবাদ গ্রহণ করতে পারেনি তাদের অধঃগতি ও অবিপ্লবী হয়ে পড়া অনিবার্য হয়ে পড়েছে। স্মরণ করা যাক, "জাতীয় যুদ্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির স্থান" আলোচনায় মাও সে তুং যা বলেছিলেন, "মার্কস, এঙ্গেলস্, লেনিন, স্তালিনের তত্ত্ব সর্বত্রই প্রযোজ্য। তবে একে বেদবাক্য বলে মনে করা উচিত নয়, বরং কর্মের পথ নির্দেশক বলে মনে করা উচিত। শুধু মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কতকগুলো পদ বা শব্দসমষ্টি শেখা উচিত নয়, বরং তাকে বিপ্লবের বিজ্ঞান হিসেবে শেখা উচিত। ব্যাপক বাস্তব জীবন ও বিপ্লবী অভিজ্ঞতাকে গবেষণা করার মাধ্যমে মার্কস, এঙ্গেলস্, লেনিন, স্তালিন সাধারন নিয়ম সম্পর্কে যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা উপলদ্ধি করা উচিত, শুধু তাই নয়, বরং সমস্যার পর্যবেক্ষণ ও সমাধানে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী ও পদ্ধতিকে ও শেখা উচিত।" 

১২.
জনগণ এবং কেবল জনগণই হচ্ছেন বিশ্ব ইতিাহাস সৃষ্টির চালিকা শক্তি এবং গণলাইনের ধারণাকে মাও আরও বিকশিত করেন। তিনি বলেছেন, জনগণের ধারণাকে সংগ্রহ করুন, সে সবকে সুসংবদ্ধ করুন এবং তারপর সেই সব ধারণা নিয়ে জনগণের কাছে যান। তাদের নিকট এসব ধারণা প্রচার ও ব্যাখ্যা করতে থাকুন যতক্ষণ না তারা সে সবকে নিজেদের ধারণা বলে গ্রহণ করছেন এবং অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় সে সব ধারণার সঠিকতাকে যাচাই করুন। মাও সে-তুঙ বস্তু থেকে চেতনা ও চেতনাকে বস্তুতে রূপান্তরে দ্বন্দ্বের নিয়মকে রাজনীতিতে প্রয়োগ করেছেন এবং জনগণের কাছে দর্শনকে নিয়ে গেছেন যে কর্তব্য সম্পাদন করতে মার্কসবাদে বাকি ছিল। এভাবে মানব জাতির সকল কর্মকাণ্ডে মানুষের সচেতন গতিশীল ভূমিকার ধারণাকে আরো একধাপ বিকশিত করেন। গবেষকগণ তাই বলছেন, চীনা পার্টি কিভাবে সূত্রবদ্ধ করলো তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাও সে-তুঙ প্রায় অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল চীন বিপ্লবে নেতৃত্ব প্রদনের প্রক্রিয়ায়, বিশ্বব্যাপী আধুনিক সংশোধনবাদীদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং সর্বশেষ সমাজতান্ত্রিক সমাজে পুঁজিবাদের পুনরুত্থানের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ ও করণীয় নির্ধারণের মাধ্যমে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে বিপুলভাবে বিকশিত করেছেন। এসব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মাও দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এই সকল ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রেখেছেন। মাও সে-তুং সর্বহারাশ্রেণীর দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে বিকশিত করেন। দ্বন্দ্বে সার্বজনীনতা বিশ্লেষণ ও প্রধান দ্বন্দ্ব নির্ধারণের গুরুত্বকে উপলব্ধির বিকাশ নতুন স্তরে উন্নীত করেন। তিনি আরও জোর দেন, দ্বন্দ্বের নিয়ম তথা বিপরীতের একত্ব ও সংগ্রাম হচ্ছে প্রকৃতি ও সমাজকে পরিচালনাকারী মূল নিয়ম। এ উপলব্ধিকে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে প্রয়োগ করেন তত্ত্ব ও অনুশীলনের মধ্যকার সম্পর্ক বিশ্লেষণে। তিনি অনুশীলনকে সত্য যাচাইয়ে মানদণ্ড হিসেবে জোর দেন। তত্ত্ব-অনুশীলন-তত্ত্ব এভাবে তত্ত্বকে বিপ্লবী অনুশীলনের মধ্য দিয়ে মাও সর্বহারা জ্ঞানতত্ত্বকে আরো বিকশিত করেন। যা ১৯৩৭ সালে “অনুশীলন সম্পর্কে” এবং “দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে” নিবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক যুগান্তর, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত