জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল

প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩৩

১.
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল। মনে রাখবার মতোন স্মরণীয় বিশিষ্টজনের জীবনী রচনার অনুসন্ধিৎসু পাঠক হিসেবে আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিবেচনায় শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল স্যার ছিলেন জ্যোর্তিময়ী মানুষ, ইতিহাসের একনিষ্ঠ নিরব সাধক। শাহরিয়ার ইকবাল ১৯৪০ সালের ১৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় প্রজ্ঞাবান প্রিয় মানুষের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল কানাডায় মৃত্যুবরণ করেন। 

২.
শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল স্যার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দাত্বি পালন করেছেন সততার সাথে, দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে। সুনাম অক্ষুন্ন রেখে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে তাঁর মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন তিনি চাকুরিজীবনের শেষকালে যেমন পাননি, তেমনি প্রয়াণের পরও পেলেন না দেখে আমার মতোর তাঁর অনেক স্বজনই ব্যথিত। আমি আমার খুব প্রিয় ও আস্থাবান জ্ঞানী স্বজনকেই হারালাম না, আলোকের এক আস্থাবান উৎসকেও হারালাম। এ ক্ষতি অপূরণীয়, পোষাবার নয়। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, তাঁর জীবন, কর্ম ও চিন্তা চর্চায় ব্যাপৃত তারা প্রতিনিয়ত শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল স্যারের ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ বছরের দৈনন্দিন কর্মতালিকা ও কতিপয় দলিল’ গ্রন্থটির প্রতি সবিশেষ মনোযোগী পাঠক না হয়ে পারি না। 

৬.
শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল স্যারের জানাযা শেষে স্মৃতিচারণকালে তাঁর সহকর্মীদের অন্যতমজন, প্রাক্তন সচিব রাব্বানী (Kamrul A Rabbani) স্যার অনেক অজানা গুণের কথা শোনালেন, যা তাঁর সততা, যোগ্যতা আর দক্ষতাকেই ফুটিয়ে তুললো। প্রাক্তন সচিব মোফাজ্জল করিম স্যারসহ আরো অনেকের কাছ থেকেই শাহরিয়ার ইকবাল স্যারকে নিয়ে শুনলাম, জানলাম। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, লোক গবেষক শামসুজ্জামান খান (Shamsuzzaman Khan) তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণকালে যথার্থই লিখেছেন, ‘যখন বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে আনা যায় না তিনি তখন পাকিস্তান গণপরিষদে দেয়া তাঁর ইংরেজি ভাষণের সংকলন প্রকাশ করেন। সে ছিল এক দু:সাহসী কাজ। সংকলক-সম্পাদক হিসেবে নাম দিয়েছিলেন Ziaur Rahman. এতে তাঁর কৌতুক বোধ ছিল --নিজেকে আড়াল করার প্রয়াস ছিল না। তাঁর নামের একটা অংশ Ziaur Rahman. তিনি একটা Fun হিসেবে একটু ধন্দ সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।’ আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম (Abul Kashem) স্যার মরহুমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করে জানাচ্ছেন, ‘Sheikh Mujib in Pakistan Parliament (1955-58) বইটি তিনি প্রথমে জিয়াউর রহমান ছদ্মনামে এডিট করে প্রকাশ করেন। পরে ১৯৯৭ সালে নিজ নামেই এটি প্রকাশ করেন।’ শাহরিয়ার ইকবাল স্যারের পরম স্বজন প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব এবং দিল্লীতে আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী স্যারের তাৎক্ষণিক অনুভূতি ছিলো এমন, ( Syed Muazzem Ali New Delhi, India ) ‘Deeply shocked and grieved to know about the passing away of Mr. Shaharyar Iqbal in Canada today. During his assignment in Maulvi Bazar in 60s as a Magistrate, he and his wife late Dolly Apa came in close contact with my parents and my siblings and they have always been friends and well wishers of our family. May Allah rest his and her souls in Jannah and give courage and fortitude to their children to bear this irreparable loss. Ameen.’

৭.
শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল ৭৭ বছর বয়সে কানাডার টরেন্টো শহরে মেয়ের বাসায় ইন্তেকাল করেন। তিনি মেয়ে জিনাত রহমান ও ছেলে তওসিফ রহমানের বাবা । তাঁর স্ত্রী মরহুম অধ্যাপক খাদিজা রহমান সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল প্রশাসনিক ক্যাডারের সদস্য হিসেবে সর্বশেষ, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদ থেকে ১৯৯৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর আলোকিত পরিমণ্ডলের বাল্যবন্ধুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম- প্রফেসর নজরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, প্রফেসর আমিরুল ইসলাম চৌধুরী (প্রাক্তন ভিসি, জাবি), কেরামত মওলা, স্থপতি খাদেম আলি প্রমুখ।

৮.
শাহরিয়ার ইকবাল ১৯৪০ সালের ১৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাদের আদি বাড়ি ছিল বর্তমান মাদারীপুরের শিবচর থানার খানকান্দি গ্রামে। শৈশবে ঢাকার নওয়াবপুর সরকারি হাইস্কুল, রাজশাহী জিলা স্কুল এবং ঢাকার নটরডেম কলেজে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে মাস্টার্স, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে বিভাগে মাস্টার্স এবং লেবাননের বৈরুতে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে জনপ্রশাসন বিষয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। লেখাপড়া শেষে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সময় মৌলভীবাজারে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রশাসনিক ক্যাডারে কর্মজীবন শুরু করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার সহকারী একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন শাহরিয়ার ইকবাল। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের প্রথম ব্যবস্থাপক (প্রশাসনিক), এফডিসির মহাপরিচালক, খাদ্য অধিদপ্তর ও বিটিভির মহাব্যবস্থাপক এবং যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

৯.
নিবিড় ইতিহাসানুরাগী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন তিনি। মুঘল ভারতে নারীর ভূমিকা থেকে শুরু করে সংসদে শেখ মুজিবের ভূমিকা পর্যন্ত বহু বিচিত্র বিষয়ে রচনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ। ভারতীয় বাঙালি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, লেখক, সম্পাদক ও দার্শনিক হুমায়ুন কবিরকে নিয়ে তিনি মূল্যবান একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছিলেন এবং সেটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিতও হয়েছিলো। এই জীবনীটি ছাড়াও ‘নীল বিদ্রোহ’, ‘মোগল সমাজ’, ‘রাজনীতিতে নারী’, এবং ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ বছরের দৈনন্দিন কর্মতালিকা ও কতিপয় দলিল’সহ বিভিন্ন বই লিখেছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য এবং যুক্তরাজ্যের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো ছিলেন।

১০.
শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল স্যারের সাথে তাঁর নানা রচনা নিয়ে কথা হতো। একটি মজার বিষয় উল্লেখ করে তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে চাই। সরকার ও রাজনীতির ছাত্র হিসেবে আমাকে বৃটিশ ভারতের ইতিহাস পড়তে হয়, শিক্ষক হিসেবে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানও করাতে হয়। পলাশীর ইতিহাসের অন্যতম খলচরিত্র মীরজাফর সম্পর্কে নানা তথ্য বিভ্রান্তি ও শুদ্ধতার আলোচনাকালে স্যার মজার একটি তথ্য উপস্থাপন করেন, যেটি তাঁর রচনাতেও তিনি উল্লেখ করেছেন বলে জানিয়েছিলেন। মজার সেই বিষয়টি হলো মুন্নী বেগমের জীবনী সংক্রান্ত। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক নিযুক্ত বাংলার নওয়াব মীরজাফর এর অন্যতম স্ত্রী ছিলেন এই মুন্নী বেগম। আকবরের সমাধিস্থল সিকান্দ্রার নিকটবর্তী বলকুন্দা গ্রামে তাঁর জন্ম। দরিদ্র মা তাঁকে দিল্লির এক মহিলা নৃত্যশিল্পি বিষুর নিকট বিক্রি করে দেন। বিষু তাঁকে নৃত্যশিল্পি হিসেবে গড়ে তোলেন। বিষুর নৃত্যদলের সদস্যরূপে মুন্নী ভারতের বিভিন্ন রাজদরবার ভ্রমণ করেন। অপরূপ সৌন্দর্য এবং নৃত্যপ্রতিভার জন্য তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘসেটি বেগম ও নওয়াজিশ মুহম্মদ খানের দত্তক পুত্র ইকরামউদ্দৌলার বিবাহ উপলক্ষে বিষুর নাচের দল আমন্ত্রিত হয়। সেখানে মুন্নী বেগম তাঁর সৌন্দর্য, সংগীত এবং নৃত্যশৈলীতে অভিজাতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মুর্শিদাবাদে নৃত্যশিল্পিদের অধিকতর কদর পরিলক্ষিত হওয়ায় নৃত্যদল অনুষ্ঠান শেষে সেখানেই থেকে যায়। নৃত্যশিল্পিদের মধ্যে সবচাইতে আকর্ষণীয় ও রূপবতী মুন্নী বেগম শীঘ্রই আলীবর্দী খানএর প্রধান সেনাপতির হারেমে স্থানলাভ করেন। তাঁর তারুণ্যদীপ্ত সৌন্দর্য মীরজাফরের হূদয় জয় করে। বুদ্ধিদীপ্ত মুন্নী বেগম অচিরেই মীরজাফরের হারেমে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে মীরজাফরের প্রথম স্ত্রী শাহ খানম ও অপর স্ত্রী বাববু বেগম ম্লান হয়ে যান। আমরা জানি, অপঘাতে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি মীরজাফরের মৃত্যু হয়। মীরজাফরের অবর্তমানে তাঁর বিপুল সম্পদের অধিকারী হন মুন্নী বেগম। লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। লর্ড ক্লাইভ মুন্নী বেগমকে সান্ত্বনা প্রদান করে বলেছিলেন যে, তিনি নিজে এবং কোম্পানির অন্যান্য কর্মকর্তারা মুন্নীকে ‘তাদের মাতা’ হিসেবে সম্মান দেবেন। মুন্নী বেগম ক্লাইভকে পাঁচ লাখ রূপি প্রদানের বিনিময়ে তাঁর পুত্র নাজমুদ্দৌলাকে মসনদে বসাতে সক্ষম হন। মুন্নী বেগম অন্দরমহলের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি প্রাসাদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পালন করতেন। প্রাসাদের কর্মচারীদের বেতন, জেনানামহলের ভরণ-পোষণ, অতিথি আপ্যায়ন এবং ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের জন্য প্রতি মাসে তাঁর মাধ্যমে প্রায় তেইশ হাজার রূপি ব্যয়িত হতো। মহাপ্রতাপশালী এই নারী মুন্নী বেগম ১৮১৩ সালের ১০ জানুয়ারি সাতানববই বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও মণিমুক্তা রেখে যান। তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ফোর্ট উইলিয়মে ব্রিটিশ পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং নববইবার তোপধ্বনি করা হয়। মীরজাফরের পারিবারিক সমাধিস্থলে তাঁকে সমাহিত করা হয়। বৃটিশ রাজ কর্তৃক মুন্নী বেগমের মৃত্যুকে সরকারিভাবে মহিমান্বিত করণের ইতিহাস আমাদের অনেক ভাবনার খোরাক জোগায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত