জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

খোন্দকার নূরুল আলম

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩০

১.
‘চোখ যে মনের কথা বলে’ গানটি শোনেননি এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে। এ গানের সুরস্রষ্টা দেশবরেণ্য সঙ্গীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী খোন্দকার নুরুল আলম। খ্যাতিমান সুরস্রষ্টা ও কণ্ঠশিল্পী খোন্দকার নূরুল আলম ১৯৩৬ সালের ১৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের এ সুরস্রষ্টার জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারি ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। গানের সঙ্গেই আজন্মের জীবনের সংসার পেতেছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ খোন্দকার নূরুল আলম। ‘চোখ যে মনের কথা বলে’, ‘এতো সুখ সইবো কেমন করে’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’, ‘আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে’, ‘কাঠ পুড়লে কয়লা হয়’, ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’ প্রভৃতি কালজয়ী সুর তৈরি করেছেন এ সুরস্রষ্টা। বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ খোন্দকার নূরুল আলম ‘শুভদা’ ছবির সংগীত পরিচালনার জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান খোন্দকার নূরুল আলম। আরো একাধিকবার পেয়েছেন এই পুরস্কার। পেয়েছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘একুশে পদক’, ‘বাচসাস পুরস্কার’, ‘চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার’সহ আরো অনেক সম্মাননা। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার তিনি পেয়েছেন তাঁর গানের ভক্ত-শ্রোতা ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাউল কানাইলাল শীলের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মীয়গণ তাঁর প্রিয় দোতারাটি উপহার দিয়েছিলেন খোন্দকার নূরুল আলমকে, যা তিনি সময় পেলেই ড্রয়িং রুমে বসে বাজাতেন।

২.
সংগীতজগতে তাঁর প্রবেশ-লগ্নে খোন্দকার নূরুল আলম নিজের সুরে নিজেই গান গেয়েছেন এবং মাঝেমধ্যে সেইসব গান নিজেই লিখেছেন। পরবর্তীকালে সুরকার ও সংগীতপরিচালক হিসেবেই তিনি হয়ে ওঠেন অনন্যসাধারণ। যৌবনে তাঁর নিজের কন্ঠে গাওয়া “চোখ যে মনের কথা বলে”, “আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে”, “দু’নয়ন ভরে যত দেখি”, “প্রথম দেখায় লাগলো ভালো” গানগুলো আজও সমান জনপ্রিয়। সংগীতবোদ্ধাদের মতে, খোন্দকার নূরুল আলমের সুর-সাধনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর মৌলিকত্ব। এই মৌলিকত্বের মূলে রয়েছে সংগীত বিষয়ে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, বহুমাত্রিক সুরের অনুশীলন এবং অহমিয়া (আসাম) ঐতিহ্যের সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় ধারার সফল সংমিশ্রণ। আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের গান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নকল সুরের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ভারতীয় হিন্দি, তামিল-তেলেগু, এমনকি নেপাল-ভুটান ও শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় গানের সুরে বাংলা কথা বসিয়ে বাজার মাত করেছেন তাঁর কালের অনেক সংগীতপরিচালক। খোন্দকার নূরুল আলম কখনো তা করেননি। কোনও ছবির পরিচালক এমনটি চাইলে তিনি চুক্তি বাতিল করে সে ছবির সংগীত পরিচালনা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বরেণ্য সুরকার, সংগীত পরিচালক ও গায়ক খোন্দকার নূরুল আলমের সুর করা জনপ্রিয় গানের মধ্যে আরো রয়েছে ‘এত সুখ সইবো কেমন করে’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে’, ‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে’, ‘কাঠ পুড়লে কয়লা হয়’, ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘আমার যা আছে সবই দেব তোমায় ওগো জন্মভূমি’, ‘আমি সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে অনেক করেছি ফন্দি’, ‘তোমাকে দেখলাম যেদিন প্রথম’, ‘তোমার এই উপহার আমি চিরদিন রেখে দিব’, ‘এ হূদয়ে এত যে কথার কাঁপন’, ‘জনম জনম ধরে প্রেম পিয়াসী’, ‘যদি মরণের পরে কেউ প্রশ্ন করে’ প্রভৃতি। খোন্দকার নূরুল আলমের সুরে কণ্ঠ দিয়েছেন সুবীর নন্দী, সৈয়দ আবদুল হাদী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, এন্ড্রু কিশোরসহ দেশের অনেক গুণী শিল্পী। জাতীয় ক্রীড়া সংগীত, স্কাউট মার্চ সংগীত, আনসার-ভিডিপি দলের সংগীত, স্কাউট মার্চ সংগীত, রোটারি ক্লাবের বাংলা ও ইংরেজি গান প্রভৃতিরও সুরকার খোন্দকার নূরুল আলম। বিভিন্ন সময় গানের স্বরলিপি এবং স্টাফ নোটেশন নিয়েও কাজ করেছেন তিনি।

৩.
খোন্দকার নূরুল আলমের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ আগস্ট ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়ী মহকুমায়। বাবা নেসারউদ্দিন খোন্দকার, মা ফাতেমা খাতুন। ১২ বছর বয়সে ১৯৪৮ সালে মাকে হারান তিনি। ওই বছরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে চলে আসে তাঁর পরিবার। কৈশোরে পিতার চাকরি সূত্রে তিনি এ-দেশের নানা শহরে বসবাস করে পূর্ববঙ্গীয় বাংলা ভাষার বিচিত্র রূপ ও রীতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং একে আয়ত্ত করেন অসাধারণ দক্ষতায়। ১৯৫৪ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন খোন্দকার নূরুল আলম। জগন্নাথ কলেজ থেকে পাস করেন ইন্টারমিডিয়েট। দুটিতেই মেধা তালিকায় স্থান পান। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি তখন থেকে সংগীতেও মনোনিবেশ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর সংগীত প্রতিভার পরিচয় পেয়ে একদল গান-পাগল সিনিয়র-জুনিয়র সহপাঠী তাঁকে নিয়ে মেতে ওঠেন। এরা হলেন: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আনোয়ারউদ্দিন খান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোস্তফা জামান আব্বাসী, কাজী আনোয়ার হোসেন, রাহাত খান, জিয়া হায়দার প্রমুখ। 

৪.
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে তিনি যখন শ্রোতাদের মন জয় করে চলেছেন তখন এক-পর্যায়ে তাঁকে পেয়ে বসে অন্যদের লেখা নতুন গানে সুর করার নেশা। প্রথম মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা একটি গানে সুর করার পর এর মেলোডি ও পর্ববিন্যাসে দক্ষতা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলেন সবাই। তাঁরা একের পর এক তাঁদের লেখা শ্রেষ্ঠ গানগুলো তাঁকে দিতে লাগলেন সুর করার জন্য। ছাত্রজীবনেই বন্ধু আনিসুজ্জামানের পিতা তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান-এর কর্মকর্তা আশরাফউজ্জামানের আগ্রহে কোনও রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই ১৯৬২ সালে রেডিওতে তালিকাভুক্ত হন সুরকার ও সংগীতপরিচালক হিসেবে। যদিও ১৯৫৯ সালে যুক্ত হন বেতারের সঙ্গে। পরের বছর কাজ শুরু করেন গ্রামোফোন কম্পানির সুরকার হিসেবে। বিটিভির জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন। নিজেও গেয়েছেন। মাঝে মাঝে গানের কথাও লিখেছেন। এর কয়েক বছর পর সংগীত প্রযোজকের চাকরি নিয়ে রেডিওতে যোগ দেন। এদেশে টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে ওটাকেও তিনি বেছে নেন তাঁর সংগীত প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে।

৫.
চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনায় খোন্দকার নূরুল আলমের অভিষেক ‘ইস ধরতি পার’ দিয়ে। ১৯৬৮ সালে বাংলা ছবি ‘অন্তরঙ্গ’ ও ‘যে আগুনে পুড়ি’র সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। দুই ছবিতেই তাঁর কাজ বেশ সমাদৃত হয়। স্বাধীনতার পর ছবির গানে আরো নিয়মিত হন। ‘ওরা ১১ জন’ ছবির গান তৈরি করে বেশ প্রশংসা কুড়ান তিনি। এ ছাড়া ‘দেবদাস’, ‘জলছবি’, ‘সংগ্রাম’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘বিরাজ বৌ’সহ বেশ কিছু ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।

৬.
১৯৭৬ সালে বিয়ে করেন খোন্দকার নূরুল আলম। বরেণ্য এই সুরস্রষ্টার সহধর্মিণীর নাম কিশওয়ার খোন্দকার এবং দুই ছেলেমেয়ে আবির খোন্দকার ও আমানী খোন্দকার।মৃত্যুর আগের কয়েক বছর অনেকটা নিভৃতেই দিন কাটিয়েছেন দুই সন্তানের এই জনক। থাকতেন ধানমণ্ডির পৈতৃক বাড়িতে।

৭.
সুরস্রষ্টা, সঙ্গীতজ্ঞ খোন্দকার নূরুল আলমের দীর্ঘ জীবনের সহকর্মী গীতিকার রফিকুজ্জামান বলেন, খোন্দকার নূরুল আলমের মতো এমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের সুরকার আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। তিনি যা কিছু করেছেন, তার সবটাই মৌলিক। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেছেন, অবিনাশী সুরের স্রষ্টা ছিলেন খোন্দকার নূরুল আলম। একজন সুরস্রষ্টা যে কতটা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হতে পারেন, তার উদাহরণও তিনি। অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, খোন্দকার নূরুল আলম কোনো অন্যায়কে কোনোদিন ছোট করে দেখেননি। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি বলেই চির অভিমানে জীবন কাটিয়েছেন। সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক শেখ সাদী খান বলেন, তিনি ছিলেন আমার জীবনের সঙ্গীতগুরু। এ জীবনে যতটুকু জেনেছি তার কাছ থেকেই শিখেছি। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, খোন্দকার নূরুল আলমের প্রতিভার প্রকাশ তার গানে ও সঙ্গীত পরিচালনায়। আপন কীর্তির মাঝেই বেঁচে থাকবেন তিনি।

৮.
প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী খোন্দকার নূরুল আলমের প্রয়াণের পরে ‘বিদায় খোন্দকার ভাই’ শিরোনামে ফেসবুক স্ট্যাটাসে আবেগঘন স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন প্রখ্যাত ছড়াশিল্পী, সাহিত্য সাধক লুৎফর রহমান রিটন। তাঁর অনুভবকে ছোঁয়ার চেষ্টা করা যাক রচনাটির উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠের মাধ্যমে। রিটন ভাই লিখেছেন, ‘কিছুক্ষণ আগে বিটিভির এককালের বিখ্যাত প্রযোজক ও সাবেক ডিডিজি কামরুন্নেসা হাসান ওরফে মেনকা হাসান মুঠোফোনে বললেন--খোন্দকার ভাই খুব অসুস্থ। ধানমণ্ডি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে আছেন। খোন্দকার ভাই মানে খোন্দকার নূরুল আলম। প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। আমাদের ভীষণ প্রিয় একজন মানুষ। বহু অনুষ্ঠান করেছি আমরা একসঙ্গে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে। বললাম, আজই দেখতে যাবো আপা। 
আপা বললেন ঠিক আছে। বিকেলে যাবো।
কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বিকেলে নয়, দুপুরেই যাবো। বন্ধু আহমাদ মাযহারের কাছ থেকে হাসপাতালের লোকেশনটা জেনে নিলাম। 
খানিক বাদে মুঠোফোনে আবারো ভেসে উঠলো মেনকা আপার নাম। বুকটা কেঁপে উঠলো। দ্রুত কল রিসিভ করতেই ওপাশে মেনকা আপার কান্না--রিটন খোন্দকার ভাই নেই, এইমাত্র চলে গেলেন। সাবিনা ইয়াসমিন এইমাত্র জানিয়েছেন...।
ওপাশে মেনকা আপা আর এইপাশে আমি, আমরা দু'জনেই কাঁদছি আমাদের প্রিয় খোন্দকার ভাইয়ের জন্যে। এক সময় বিটিভিতে সানজিদা আখতারের উপস্থাপনা ও কামরুন্নেসা হাসানের প্রযোজনায় গানের অনুষ্ঠান 'বর্ণালী' প্রচারিত হতো। আমি ছিলাম সেই অনুষ্ঠানের একজন সক্রিয় কর্মী। টেলপে আমার নাম যেতো গবেষক হিশেবে। বর্ণালী ছিলো বিষয় ভিত্তিক গানের অনুষ্ঠান। প্রতিটি অনুষ্ঠানে অনেকগুলো পুরনো গানের সঙ্গে একটি নতুন সদ্যলেখা গান প্রচারিত হতো। আর নাওতুন গানটি লিখতাম আমি। দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বর্ণালী অনুষ্ঠানের নিয়মিত সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন খোন্দকার নূরুল আলম। তাৎক্ষণিক লেখা আমার বেশ কিছু গানে অসাধারণ কিছু সুর সংযোজন করেছিলেন খোন্দকার ভাই। এমনও হয়েছে, বিটিভি ভবনে জেনারেল ম্যানেজার নওয়াজীশ আলী খানের কক্ষে আমাদের বর্ণালী টিমের মিটিং চলাকালেই বিষয়ভিত্তিক নতুন একটা গান আমি লিখে দিয়েছি। খোন্দকার ভাই খুব এপ্রিশিয়েট করতেন আমার গান লেখার ব্যাপারটিকে। বলতেন, কবিরা গান লিখলে গান ভালো না হয়ে পারে না। কিন্তু আমি গীতিকার হতে আগ্রহী ছিলাম না বলে কাজের অংশ হিশেবে, দায়িত্ব হিশেবে একটিমাত্র গান লিখেই নিজেকে থামিয়ে দিতাম। খোন্দকার ভাই তাতেও মজা পেতেন। বলতেন তুমি তো ছড়াকারই। সেই পরিচয় তো তোমার রইলোই। হোক না কিছু গান। কিন্তু আমি পালিয়ে বেড়াতাম। 
কী অসাধারণ সুর স্রষ্টাই না ছিলেন খোন্দকার ভাই! আমাদের চলচ্চিত্র কিংবা আধুনিক বা দেশাত্ববোধক গানে খোন্দকার ভাই-এর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। কালজয়ী কিছু গানের সুরকার এবং শিল্পী হিশেবে তিনি অমরত্ব পেয়ে গেছেন বলা চলে। তাঁর সুরারোপিত বিখ্যাত কয়েকটি গানের কথা কথা বলতে পারি। খোন্দকার ভাইয়ের গাওয়া একটি অসাধারণ আধুনিক গান--'তুমি ভয় পেও না ভয় পেও না/আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে/জোছনা লুকাতে......আহা কী দুর্দান্ত কথা আর সুর আর গায়কী! খোন্দকার ভাইয়ের গাওয়া আরেকটি গান-- 'চোখ যে মনের কথা বলে/চোখে চোখ রাখা শুধু নয়/চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে চোখের মতো চোখ থাকা চাই...। আমার প্রজন্মের যে কেউ এই গানটা শুনেছেন। তখন রেডিওতে নিয়মিত বাজতো। চলচ্চিত্রের নাম 'যে আগুনে পুড়ি'। লিপসিং ছিলো নায়ক রাজ্জাকের। তাঁর সুরে নীলুফার ইয়াসমিনের গাওয়া--'এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে/আমার পৃথিবী থেকে......কিংবা 'এতো সুখ সইবো কেমন করে'......গান দুটো কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? কিংবা দেশাত্ববোধক গানের কথা যদি বলি---দু'নয়ন ভরে যতো দেখি তারে/আরো দেখি মনে হয়/আর কোনো রূপ/দেখি অপরূপ/বাংলার মতো নয়......খোন্দকার ভাইয়ের গাওয়া এই গানটি তো রীতিমতো ইতিহাস হয়ে আছে। 
কতো শতো স্মৃতি আমার, খোন্দকার ভাইকে ঘিরে! কতো কথা! কতো হাসি। অতো অনাবিল প্রাণবন্ত আড্ডা বিটিভি ভবনে, কামরুন্নেসা হাসানের কক্ষে!’

৯.
খোন্দকার নূরুল আলমের সময়ের সব গুণী শিল্পীই গেয়েছেন তাঁর সুর-করা গান। গানের বাণী নির্বাচনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত রুচিশীল। ১৯৯৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “ভালো বাণী না-হলে সুর করতে পারি না, এটিই আমার সীমাবদ্ধতা... আমার সৌভাগ্য বলতে পারেন শুরু থেকেই বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিকের কাব্যগুণসমৃদ্ধ গানে সুর করার সুযোগ পেয়েছি আমি; এরা হলেন আহসান হাবীব, হাবীবুর রহমান, সিকানদার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ রকিকউজ্জামান থেকে আজকের আবিদ আনোয়ার।”

১০.
বাংলা গান বাণীপ্রধান-এই মহাসত্য উচ্চারিত হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের মুখে। আরোপিত সুরের কারণে বাণী হারিয়ে গেলে আধুনিক গানের শ্রোতার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। গান কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে এর বাণীর অন্তর্নিহিত কাব্যময়তার গুণে এবং বাক্যের পর্ববিন্যাস (স্ক্যানেশান)-এর সাবলীলতা ও স্বাভাবিকতার কারণে। এই সত্য পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করেছিলেন উচ্চশিক্ষিত সুরকার খোন্দকার নূরুল আলম। বাদ্যযন্ত্রের দাপটে কিংবা অসঙ্গত পর্ববিন্যাসে যেন গানের বাণী হারিয়ে না যায় সেদিকে তাঁর কড়া নজর ছিলো। তাই এতসব সমৃদ্ধ গান সৃষ্টি হয়েছে এই অনন্যসাধারণ সংগীতজ্ঞের সুরকে ধারণ করে। কাব্যগুণসম্পন্ন গান বরাবরই জনপ্রিয় হতে বেশ সময় নেয়। খোন্দকার নূরুল আলমের সুর-করা অনেক গান রয়েছে যেগুলো প্রচলিত অর্থে জনপ্রিয় নয় কিন্তু সেগুলোর সুরেও রয়েছে বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর যা অনুধাবন করতে পারেন কেবল প্রকৃত সংগীতবোদ্ধাগণ।

১১.
খোন্দকার নূরুল আলম আজ বেঁচে নেই কিন্তু তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর সৃষ্ট গানগুলোর জন্য যতদিন মানুষ বাংলা ভাষার গান শুনবে।

(তথ্যসূত্র : বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত