প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কবি শামসুর রাহমান

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০১৮, ১০:৫৫

১.
কবি শামসুর রাহমান, কবিতার বরপুত্র তিনি, আধুনিক বাংলা কবিতার অমর স্রষ্টাও বটে। বিষয়ে, আঙ্গিকে, উপস্থাপনায় তাঁর কবিতা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। শামসুর রাহমানের জীবন জুড়েই ছিল কবিতা। শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন জাতির প্রিয় কবি। বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবি মৃত্যুবরণ করেন ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায়। আধুনিক কবিতার অমৃত পুত্র শামসুর রাহমানের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর সকালে জন্মগ্রহণ করেন কবি শামসুর রাহমান। আঠার বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন তিনি। জীবদ্দশাতেই শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী কবিপুরুষ। শুধু লোকপ্রিয়তা নয়, কবি হিসেবে অতুলনীয় সিদ্ধি অর্জন করেছিলেন তিনি। বহুবিস্তৃত বিষয়, ভাষিক বহুস্বর আর বহুমাত্রিকতায় গভীর তাঁর কাব্যজগত। একদিকে নৈঃসঙ্গ্যে নিমজ্জিত ব্যক্তিক মনোবাস্তবতা, অন্যদিকে যুথবদ্ধ জাতিগত সংগ্রাম আর আন্দোলনের অংহকারকে তিনি কবিতায় চমৎকারভাবে উপজীব্য করে তুলেছেন। বাঙলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান কেবল সংখ্যার বিচারে নয়, তাঁর কাব্যকুশলতা বাংলা সাহিত্যকে নতুন ঢঙে, নতুন মাত্রায়, স্বদেশ-স্বাদেশীকতায় উন্নীত করেছে।

২.
মনে পড়ে, একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার পক্ষ থেকে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে একটি কবিতা আনতে কবি শামসুর রাহমানের শ্যামলীর বাসায় প্রথম যাই। তাঁর লেখার সাথে স্কুল জীবন থেকেই পরিচয় থাকলেও কবির সাথে এই প্রথম সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ। সে এক অন্যরকম আনন্দ অনুভূতিই বটে! এরপর কবির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয়ের সুযোগ আসে কয়েকটি কারনে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং তৎকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ভোরের কাগজে কাজ করার পাশাপাশি বিশ্ববরেন্য বাঙালি জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের জাদু দলের সদস্য হিসেবে কবি শামসুর রাহমানের একান্ত সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ ঘটে আমার। অনেক স্মৃতির মধ্যে আজ বেশি মনে পড়ছে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাঁর পাশে বসে বিশ্বখ্যাত দু’জন সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ রবিশঙ্করের সেতার বাদন এবং পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশীর সুরে মোহিত হওয়ার সময়গুলি। জুয়েল আইচের কল্যাণে সেসব অসাধারণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আমার সুযোগ ঘটতো। মনে পড়ছে এরকমই দু’টি অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমানের পাশে বসে (কবির চোখের সমস্যার কারণে তাঁর সহযোগি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্যই আসলে পাশে বসার সুযোগগুলো আমি পাই) অনুষ্ঠান উপভোগ করি এবং কবিকে তাঁর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি, সেসময়ে অনেক কথাও হয়, সেসবও মনে পড়ছে আজ। জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ এবং বিপাশা আইচকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন, গর্বও করতেন। সেসব কথা তিনি লিখেছেনও নানা সময়ে, বলতেনও সুযোগ পেলেই, যেমনটি বলতেন হুমায়ুন আহমেদ কিংবা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ।স্মৃতির অ্যালবাম খুঁজতে গিয়ে আজ হাতের কাছেই জাদুশিল্পী জুয়েল আইচকে নিয়ে লেখা কবি শামসুর রাহমানের যেমন একটি কবিতা খুঁজে পেলাম, সেই সাথে দু’জনের একটি বিরল ছবিও। 

৩.
কবি শামসুর রাহমানের বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী, মা আমেনা বেগম। আধুনিক বাংলা কাব্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের পড়াশোনায় হাতেখড়ি পুরান ঢাকার বিখ্যাত পোগোজ স্কুলে। ঢাকা নগরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। নাগরিক কষ্ট, দুঃখ-সুখ তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। জীবনের সত্য-সুন্দরকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। পাশাপাশি বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত অধ্যায় ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। ৬০টি কাব্যগ্রন্থসহ প্রকাশিত গ্রন্থ শতাধিক। পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকসহ একাধিক পুরস্কার। আরেক প্রধান কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যথার্থ বলেছেন - "তাঁর সব রচনা বিশ্ব সাহিত্যের অন্তর্গত , তাঁর পা সব সময় গাঁথা থেকেছে স্বদেশের মাটিতে ।" সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, ‘শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতা যেমন উদ্দীপক হয়ে কাজ করে তেমনি প্রেমের কবিতাতেও তিনি অনন্যসাধারণ। তার রূপকল্প-চিত্রকল্প নির্মাণের অসাধারণত্ব বিশেষভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। শামসুর রাহমান ত্রিশের দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আমাদের কাব্য-ভাষা বিবর্তনের সাঁকো হিসেবে কাজ করে গেছেন। ’ তাই বিনা সংকোচে বলা যায় কবি শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার ঐশ্বর্যমন্ডিত অধ্যায়। তাঁর জীবনের বড় অংশটি জুড়ে ছিল কবিতা। পুরান ঢাকায় বেড়ে ওঠার কারণে নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ কবিতায় তুলে আনতে সক্ষম হন তিনি। বলা হয়ে থাকে জীবনানন্দপরবর্তী বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার পথে ধাবিত করায় তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। নানাভাবে শামসুর রাহমান তাঁর সময়, সমসাময়িক রাজনীতি, দেশ, দেশের ভবিষ্যত সচেতন কবি ছিলেন। তাঁর লেখা ধারণ করেছে কাল, রাজনীতি, দেশপ্রেম, দেশভাবনা ও আত্মজাগরণ। এই জীবনবোধ দেশের জন্য মমতা ও প্রেম শামসুর রাহমানকে আবার পরিণত করেছিল বিশ্ব নাগরিকে। ষাটের দশকের গোড়ার দিকেই তাঁর কবি প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত হতে থাকে সাহিত্যের ভুবন। ‘উনিশ শ’ ঊনপঞ্চাশ’ রচনার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে পদচিহ্ন আঁকেন কবিতার আঙ্গিনায়। এটি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। সূচনাটা অস্তিত্ববাদী ইউরোপীয় আধুনিকতা দিয়ে হলেও পরে দেশজ সুর ও ঐতিহ্যকে কবিতায় ধারণ করেছেন। চিত্রকল্পময় কবিতার সূত্র ধরে বাংলা কবিতাপ্রেমীদের নজর কাড়েন শামসুর রাহমান। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে।’ কবির নিমগ্ন অন্তর্গত বোধ ও ভাবনার জগতের অপূর্ব রূপায়ণ ছিল এ কাব্যগ্রন্থ। ষাটের দশকে প্রকাশিত কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ছিল, রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, আমি অনাহারী ইত্যাদি। একইসঙ্গে কবিতার জমিনে তিনি পরিস্ফুটিত করেছেন চিরকালীন বেদনা, প্রেম, মৃত্যু, ভালবাসাসহ নানা বিষয়ের শৈল্পিক ব্যঞ্জনা। নগর জীবনের প্রতি ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে গদ্যগ্রন্থ ‘স্মৃতির শহর।’

৪.
দুর্বোধ্যতার সমস্ত কাঁটাতার ছিন্ন করে তিনি পৌঁছে গেছেন সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে। হয়ে উঠেছেন গ্রহণীয় ও প্রিয়। এপার- ওপার দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তাঁর স্বীকৃতি সমগ্র বাংলাজুড়ে। শামসুর রাহমান নির্মাণ করেছেন অনেক অসামান্য কবিতা। দেশ, দেশের মানুষ, স্বাধীনতা আর মাতৃভাষাকে নিয়ে তাঁর রচিত কবিতাগুলো আজ ইতিহাস হয়ে আছে। শামসুর রাহমানের কবিতা ক্রমশ দেশ ও জাতির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে। আশা, স্বপ্ন আর ভালোবাসার পাশাপাশি অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাঁর কবিতায়। শুভবোধ ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিরন্তর লড়ে গেছেন। আর তাই ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছেন জাতির কণ্ঠস্বর। হয়ে উঠেছেন জাতীয় ইতিহাসের অনন্য ভাষ্যকার। তিনি আজ নেই কিন্তু আছে তাঁর সৃষ্টি সম্ভার, যেগুলো আমাদের আলোকিত করবে সবসময়। স্বপ্ন দেখাবে, পথ দেখাবে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের। যেমনটি বলেছিলেন কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘ঢাকা শহরের কবি’ শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘আসাদের শার্ট’ হয়ে ওঠে ‘বিদ্রোহের লাল পতাকা।’মাওলানা ভাসানীর ‘সফেদ পাঞ্জাবি’তাঁর কাছে শুধুই ‘শান্তির নিশান’নয়। একাত্তরের ঢাকা তাঁর কাছে শুধু অবরুদ্ধ নগরী মাত্র নয়। ‘শামসুর রাহমানের কবিতায় তা শত্রু নিধনের সঙ্কল্পে দৃঢ়চিত্ত সাহসী মানুষের জনপদ’ (ইলিয়াস, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, সা. বা. সংখ্যা ১৯৯১ পৃ. ৫৯)। ঢাকা শহরের আন্দোলন, উত্থান পতন রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে শামসুর রাহমানের অস্তিত্বের মিশে যাওয়াকে ইলিয়াস খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে চিহ্নিত করেছেন যা প্রকারান্তরে শামসুর রাহমানের রাজনীতি সচেতনতা, দেশ ভাবনা, অন্যায় আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আর কবির ভেতরে প্রোথিত আজন্ম স্বাধীনতার আকাংখাকেই স্পষ্ট করে তোলে। 

৫.
বাংলা সাহিত্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পরই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কবিতা লেখার দাবিদার শামসুর রাহমান। সঠিকই বলা হয়ে থাকে, কবি শামসুর রাহমান একটি বিশিষ্ট ধারার ভেতর সাহিত্য চর্চা করেছেন; এবং সেই ধারা তাঁর মৌলিক অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে । তিনি তার নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করে নিয়েছিলেন। এই জনপদের শহর, প্রকৃতি, ইতিহাস সর্বোপরি মনে-প্রাণে বাঙলা-বাঙালির কথা বারবার তাঁর কবিতায় ফুঁটে উঠেছে । দেশ, এই দেশের সংস্কতি সাহিত্য, জীবনযাত্রা, ঐতিহ্য ভালবাসতেন বলেই কবি ভালবাসতেন বাংলাভাষাকে, প্রাণের চেয়ে প্রিয় বর্ণমালাকে। বাংলা এবং বাংলাভাষা ছিল তার অস্তিত্বের গভীরে এই বর্ণমালাকে নিয়ে লেখা তার উজ্জ্বল পঙ্ক্তি-
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছ আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় 
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে 
শিউলি-শৈশবে ‘পাখি সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন
......
আজন্ম স্বপ্নের সাথি তুমি ,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে,
(বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা)

৬.
তৎকালীন পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন কলমকে। রচনা করেন অজস্র অনবদ্য কবিতা। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ কবিতা। সত্তরের নবেম্বরে ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, তারও আগে ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘গেরিলা’, ‘কাক’ ইত্যাদি কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে এ দেশের কোটি মানুষের কণ্ঠধ্বনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ করে লেখেন কবিতা ‘টেলেমেকাস।’ সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। শামসুর রাহমান স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেমন ইচ্ছে তেমন করে কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যখন পদদলিত, দেশ যখন শৃঙ্খলে আবদ্ধ, হায়েনারা যখন আবার চুষে খাচ্ছে আমাদের রক্ত তখন তার কলম থেমে থাকেনি তিনি তখন লিখলেন-
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়। - (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ)

৭.
শামসুর রাহমান সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেমন কবিতার ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত মানুষকে যুগিয়েছেন প্রেরণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ একইসঙ্গে পাঠক ও বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়। শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রেম, আত্মমগ্নতা, দ্রোহ,স্মৃতিকাতরতা, নাগরিক মোহ খুব শিল্পিতভাবে জায়গা করে নিলেও দেশপ্রেম, দেশভাবনা, কাল ও জীবনভাবনা তার কবিতায় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। শামসুর রাহমানকে আন্দোলিত করেছে এদেশের সকল আন্দোলন সকল সংগ্রাম আর জনতার জাগরণ। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সশরীরে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেই আন্দোলনে আসাদের মৃত্যু তাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল লিখেছিলেন কালজয়ী সেই কবিতা ‘আসাদের শার্ট ’ -
‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ - (আসাদের শার্ট)
এই একই প্রেরণা, এই একই চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ও। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর কবি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি কিন্তু ছয়কোটি অবরুদ্ধ বাঙালীর একজন হয়ে দেখে গেছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। পৈতৃক নিবাস পাহাড়তলীতে বসে একাত্তরে এপ্রিলে একই দিনে লেখলেন দুটো কবিতা স্বাধীনতা তুমি ও তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা । লিখলেন- 
স্বাধীনতা তুমি 
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি 
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের ঊল্লাসে কাঁপা’- (স্বাধীনতা তুমি )
‘স্বাধীনতা তুমি’কবিতাটি এভাবে শুরু করে তিনি স্বাধীনতাকে এমন সব চিত্রকল্পের সঙ্গে, আমাদের চেনা জীবন, আমাদের প্রিয়জন, আমাদের রাজনীতি, আমাদের চেনা সংগ্রামের সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত করলেন যে কবিতাটি স্বাধীনতা শব্দের প্রতিশব্দ আর আমাদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার প্রতিরূপ হয়ে উঠল। স্বাধীনতার সেই অদম্য স্পৃহায় কবিতাটি তিনি শেষ করেছেন এইভাবে :
‘স্বাধীনতা তুমি 
বাগানের ঘর, কোকিলের গান
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা 
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’
স্বাধীনতার এই স্বপ্ন কবিকে প্রত্যয়ী করেছিল। রক্তে যে স্বাধীনতার ডাক, যে স্বাধীনতা রক্তক্ষয়ী, মায়ের কোল খালি করা,বধূর সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয়া, বোনের বুক থেকে ভাইকে কেড়ে নেয়া আর লক্ষ নারীর ইজ্জত হারানোর। স্বাধীনতা যে আসবেই এ বিষয়ে দ্বিধাহীন ছিলেন কবি-
‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
জলন্ত ঘোষণার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে
নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক 
এই বাংলায়,
তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা’
(তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা)

৮.
যুদ্ধাপরাধীদের উত্থানের বিপরীতে লিখেছেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘ফুঁসে ওঠা ফতোয়া’র মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা। সময় কাল এবং দেশভাবনা থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন থাকেননি তিনি। তাঁর কবিতায় বার বার উঠে এসছে দেশপ্রেম ও দেশভাবনা। সামরিক শাসনে পিষ্ট দলিত বাংলাদেশকে দেখে বলেছেন
তুমি কি জল্লাদের হ্যাট-কোট-পরা শাঁসালো 
বিদেশীকে দেখে 
তোমার উরুদ্বয় ফাঁক করে দেবে নিমিষে? - (গুড মর্নিং বাংলাদেশ)
আবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে রচনা করেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়।’ এভাবেই নিভৃতচারী ও রোমান্টিক কবি শামসুর রাহমান হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের সমকালের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কাব্যভাষ্যকার। কবি এরপর অভিশাপ দিয়েছেন সেই সব রক্তখেকো হায়েনাদের-
‘তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমার বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে’…(অভিশাপ দিচ্ছি)
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান বুকে লিখে শহীদ হয়েছিল নূর হোসেন তাকে নিয়ে লিখেছেন- 
‘বাংলাদেশ
মনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে তার
বুক থেকে অবিরাম রক্ত ঝরতে থাকে ঝরতে থাকে।’- (বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়)

৯.
শামসুর রাহমানের কবিতায় পুরাণের ব্যবহার আছে এক কথায় ব্যাপকভাবেই।যেমন ইকারুসের আকাশ কবিতায় শামসুর রাহমান এক তরুণের স্বাধীনতার ইচ্ছা-স্বপ্নকেই রূপায়িত করেছেন, যা গ্রেকো মিথের ইকারুসের ছিলো। যে কোনো তরুণ চায় বাবা-মায়ের শাসন আর নিয়ন্ত্রণের শেকল ছিঁড়ে ‘স্বাধীন’ হতে। ইকারুসও চেয়েছিলো। তার সেই ইচ্ছা-স্বপ্ন বাস্তবায়নে গেলে তার অপ্রতিরোধ্য উচ্চাভিলাষের কারণে মোমের সাহায্যে লাগানো পাখির পালকের পাখা সূর্যেও তাপে গলে গেলে তার পতন হয় সমুদ্রসলিলে, এবং তার মৃত্যু ঘটে। ‘ তাই কামোদ্দীপ্তা যুবতীর মতো/প্রবল অপ্রতিরোধ্য আমার উচ্চাভিলাষ আমাকে অনেক/ উঁচুতে মেঘের স্তরে স্তরে/ রৌদ্রের সমুদ্রে নিয়ে গেলো।...অর্জন করেছি আমি অকাল লুপ্তির বিনিময়ে/সবার কীর্তনযোগ্য গাথা,/যেহেতু স্বেচ্ছায়/করেছি অমোঘ নির্বাচন/ ব্যাপ্ত জ্বলজ্বলে, ক্ষমাহীন, রুদ্র নিজস্ব আকাশ।’(ইকারুসের আকাশ) ইকারুসের এই স্বনির্বাচিত আত্মহননের কারণ তার জবানিতেই মেলে। ঈগলের মতো আকাশে উড়ার দুর্নিবার সাধ আর উপরে উঠার উচ্চাভিলাষই ইকারুসের এই পরিণতি। এ-জন্য উচ্চাভিলাষ ভালো কিছু নয়। অভিলাষ থাকা ভালো, যা বাস্তব আর সাধনযোগ্য, পাখির মতো উড়ার শখ, পাখির পালকের ডানা দিয়ে, তা আত্মহননেরই সামিল।

১০.
শামসুর রাহমান ১৯৫৭ সালে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজ-এর সহসম্পাদক হিসেবে। কিছুদিন এ পত্রিকায় কাজ করার পর তিনি পেশা পরিবর্তন করে যোগ দেন রেডিও পাকিস্তানে। কিন্তু রেডিও-তে অনুষ্ঠান প্রযোজকের কাজেও তিনি স্বস্তি বোধ করেননি। ফলে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি রেডিও-তে কাজ করার পর ১৯৬৪ সালে মর্নিং নিউজে উচ্চতর পদে যোগ দেন। ‘তিনশো টাকায় আমি’ প্রথম কাব্যের এ সনেটে, চাকুরি জীবনের ঠুনকো নিশ্চয়তা ও বাস্তবিক পরনির্ভরতা বিষয়ে রসিকতা করেছেন কবি নিজেকে নিয়ে। কবিতায় রয়েছে তিনশো টাকার কথা, কিন্তু বাস্তবে মর্নিং নিউজে তাঁর বেতন ছিল একশো পঁচিশ, আর রেডিও-তে দুইশো বিয়াল্লিশ, সবসমেত বেতন বিষয়ক তথ্যটি তিনি নিজেই সরবরাহ করেন, তাঁর আত্মজীবনীতে। তবে চাকুরি হিসেবে কোনোটাই তাঁর মনোপূত ছিল না। সাংবাদিকতা পেশার সুবাদে তাঁর কবিতায় রয়েছে বিস্তর সাংবাদিকতার উপাদান, কিন্তু সবই তাঁর কবিত্বের রসে জারিত।

১১.
ছড়াকার হিসেবে শামসুর রহমান নিঃসন্দেহে প্রথম সারির একজন। তাঁর আটটি ছড়ার বই, এর প্রথমটির প্রকাশকাল ১৯৭৪, শেষটির ২০০৫। এক পর্যায়ে বেশ কিছু গান রচনা করেছিলেন তিনি এবং সেগুলিতে কণ্ঠ দিয়েছেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পীরা। সাহিত্য রসযোদ্ধা ও সমালোচক শামসুর রাহমানের পরিচয় বিধৃত আছে তাঁর আমৃত্যু তার জীবনানন্দ (১৯৮৬) ও কবিতা এক ধরনের আশ্রয় (২০০২) গ্রন্থ দুটিতে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে লিখিত কলামগুলির মধ্যে ষাটের দশকে দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত কলাম ওই সময়ে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
 
১২.
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য শামসুর রাহমান আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), জীবনানন্দ পুরস্কার (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৭৭), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮১), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণ পদক (১৯৮১), ভাসানী পুরস্কার (১৯৮২), পদাবলী পুরস্কার (১৯৮৪), স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৯২) ভূষিত হন। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে তিনি জাপানের মিতসুবিশি পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সালে কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকা তাঁকে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত করে। ওই বছর তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধীতে ভূষিত করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৬ সালে সাম্মানিক ডিলিট উপাধী দান করে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী।

১৩.
শামসুর রাহমান ছিলেন গণমানুষ, সমাজ ও রাজনীতি সচেতন কবি, যদিও তিনি কোন রাজনৈতিক দলে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, বা কোন দলের অন্ধ সমর্থক ছিলেন না। তাঁর এসব সচেতনতা বা চেতনা মূলত একে অপরের পরিপূরক, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মতো। সমাজমনস্ক হয়ে কখনও তিনি প্রথাগত সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, কখনও সমাজের অন্যায়-অবিচার, কুসংস্কার, ক্লেদকে উচ্চকিত করে তার অপনোদন চেয়েছেন। তিনি অবক্ষয়িত সমাজ-রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে কখনও ব্যঙ্গ করেছেন, কখনও নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে ঘৃণার তীর ছুঁড়েছেন। তাঁর কবিতায় ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের কথা, নষ্ট সমাজব্যবস্থা, নষ্ট রাজনীতি ও নষ্ট মানুষের কথা বার বার উঠে এসেছে; তাই বলে তিনি স্পষ্ট করে কখনও আশাবাদের কথা বলেননি- তা নয়। তিনি যে মূলত রোমান্টিক কবি ছিলেন, তা তার অনেক আশাবাদের কথাতেই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। রোমান্টিক বলেই বাস্তবতার নানা নষ্টামির আঁচ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাই সমাজ-রাজনীতির ত্রুটিগুলো অতি সহজেই তাঁর চোখে পড়ত। এ চোখে পড়ার পেছনে আরও একটি কারণ রয়েছে, কারণটি হলো, তিনি ছিলেন সত্য সুন্দর মঙ্গল ও কল্যাণের কবি। তিনি ছিলেন শুভবাদের কবি। তাঁর মনের মতো সমাজকে তিনি কেবলই খুঁজে বেড়াতেন এ দেশে। আর তা করতে গিয়েই তিনি তাঁর কবিতার এক বড় অংশকে এ দেশের কেবল গণমানুষের ইতিহাস নয়, সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক মিনি আর্কাইভে পরিণত করেছেন।

১৪.
কাকে বলবো সাহিত্য? প্রখ্যাত ফরাসি ভাবুক জ্যাক দেরিদাকে এরকম একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সাহিত্য হচ্ছে এমন একধরনের ‘প্রতিষ্ঠান’ যা একজন মানুষকে যেভাবে ইচ্ছে, যা ইচ্ছে, তাই বলবার অধিকার দেয়। যেহেতু সাহিত্য আমাদের কল্পজগতকে রূপ দেয়, ফলে এই অধিকার একজন ভোগ করতেই পারে; আর কবিতায় যেহেতু ‘অর্থের অনিশ্চিতি’ সবচেয়ে বেশি, ফলে কবির স্বাধীনতা প্রায় অনিঃশেষ। তবে এই স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে কবিকে তাঁর গণতান্ত্রিক দায়বোধের কথাও স্মরণ রাখতে হবে। এভাবেই কবির দায়িত্বশীলতার বিষয়টি সামনে চলে আসে, যা এড়িয়ে যাওয়া কোনো কবির পক্ষেই সম্ভব নয়। শামসুর রাহমান এই বিষয়টিকে মান্য করেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর কাব্যজগত, অভিষিক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধান কবির মর্যাদায়। আবার মালার্মে বলেছিলেন, কবির কাজ হচ্ছে একটি জাতির ভাষাকে পরিস্রুত করে সংবেদনার মাত্রাকে মহিমান্বিত করে তোলা। শামসুর রাহমানের কবিতা এভাবেই একটি সমাজের সামগ্রিক অভিজ্ঞান ও গৌরবের ভাষ্য হয়ে উঠেছে।

১৫.
বাংলাদেশের প্রধানতম কবিদের একজন ছিলেন তিনি, আজও তাই স্মরণীয় হয়ে থাকেন আমাদের মাঝে। বাঙলা সাহিত্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পরই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কবিতা লেখার দাবিদার শামসুর রাহমান। কবি শামসুর রাহমান একটি বিশিষ্ট ধারার ভেতর সাহিত্য চর্চা করেছেন; এবং সেই ধারা তাঁর মৌলিক অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি তার নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করে নিয়েছিলেন। এই জনপদের শহর, প্রকৃতি, ইতিহাস সর্বোপরি মনে-প্রাণে বাঙলা-বাঙালির কথা বারবার তাঁর কবিতায় ফুঁটে উঠেছে।ফলে দেশ ও কালের কবি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তিনি।জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান এই কবিকে।

১৬.
শামসুর রাহমানের আত্মজৈবনিক 'কালের ধুলোয় লেখা' গ্রন্থ থেকে হৃদয় সুদূর পথরেখা... পাঠ করা যেতে পারে, ‘১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি ভর্তি হই তখন স্বপ্ন দেখেছিলাম একটি বড় ভবনে প্রবেশ করব, কিন্তু এখানেও আমার স্বপ্নভঙ্গ হলো। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনটি দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে। এই ভবনের অর্ধেকটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগে পড়ে আধখানা দালান এবং কার্জন হল। আমি যখন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হই তখন এই বিভাগে বেশ ক'জন নামজাদা অধ্যাপক ক্লাস নিতেন। এঁরা হলেন এমএন ঘোষ, যাঁকে সংক্ষেপে বলা হতো এমএনজি, এসএন রায়, আমলেন্দু বসু, বিসি রায়, অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী প্রমুখ। এমএনজির দুটি ক্লাস আমাদের ভাগ্যে জুটেছিল। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মাত্র দু'দিন ক্লাস পেয়েছিলাম। তিনি সে ক্লাস দুটোতে আমাদের শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে দুটি লেকচার শুনেছিলাম। তিনি শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি বিষয়ে যা বলেছিলেন তা আজও আমার মনে জ্বলজ্বল করে। তিনি যে ব্যাখ্যা করেছিলেন তার চেয়ে গভীর কিংবা উজ্জ্বল ভাষণ বা বক্তব্য আমি কোনও পুস্তকে পাইনি। দুঃখের বিষয়, দাঙ্গার প্রকোপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু হিন্দু অধ্যাপক ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। বিখ্যাত সমালোচক অমলেন্দু বসু, যিনি বুদ্ধদেব বসুর বন্ধু ছিলেন, তাঁর একটি ক্লাস করারও সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবে বিসি রায় এবং অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর বেশ কিছু ক্লাসে আমাদের সময় কেটেছে। অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী আমাদের পড়াতেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের রোমান্টিক কবিদের কাব্য। তিনি কিটস, শেলী, বায়রনের কবিতা পড়িয়েছেন। বিসি রায় আমাদের পড়াতেন আলেকজান্ডার পোপের কবিতা। তাঁর ক্লাস আমার কাছে তেমন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। তবে এখানে তাঁর বিষয়ে একটি আলাদা ধরনের কথা বলার লোভ আমি সামলাতে পারছি না। ওয়াকিবহাল মহলের সূত্রে জানতে পেরেছিলাম, তিনি এবং হুমায়ূন কবির হিন্দু সম্প্রদায়ের একই তরুণীকে ভালোবাসতেন। তাঁরা দু'জনই সেই তরুণীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই তরুণীর শর্ত ছিল, এই দু'জন প্রণয়প্রার্থীর মধ্যে যিনি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবেন তার গলায় তিনি বরমাল্য পরাবেন। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন হুমায়ূন কবির, যিনি পরবর্তীকালে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে স্থায়ী দাগ কেটেছিলেন। তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, একজন কবি এবং বিখ্যাত সাহিত্যপত্র 'চতুরঙ্গ'র সম্পাদকও ছিলেন। যা হোক, আমাদের শিক্ষক বিসি রায় পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলেন বলে তিনি তার দয়িতাকে স্ত্রীরূপে লাভ করতে ব্যর্থ হন। তিনি শেষ পর্যন্ত বিয়ে পিঁড়িতে বসেননি।… আমার সাবসিডিয়ারি ছিল বাংলা ও ইতিহাস। বাংলা যাঁরা পড়াতেন তাঁদের মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগত অধ্যাপক বিশ্বরঞ্জন ভাদুড়ীকে। তিনি ছিলেন দীর্ঘকায় এবং সুদর্শন। সোনালি রঙের রিমলেস চশমা পরতেন তিনি। তাঁর চেহারায় ছিল বুদ্ধির দীপ্তি। তিনি আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচিত্র প্রবন্ধ পড়াতেন। মুগ্ধ হয়ে তাঁর লেকচার শুনতাম। তাঁর ক্লাস শেষ হয়ে গেলে সব ছাত্র বিদায় নেওয়ার পর আমি তাঁর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম। তাঁকে প্রশ্ন করে অনেক কিছু জেনে নেওয়ার তৃষ্ণা প্রখর ছিল আমার। ক্লাসের পাঠ্যবস্তুর বাইরে অনেক বইয়ের বিষয় সম্পর্কে জেনে নেওয়ার আমার আগ্রহ দেখে তিনি সানন্দে ক্লাস শেষ হওয়ার পরও অনেকক্ষণ ধরে আমার কথা শুনতেন এবং সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। অল্পবয়সী ছাত্র বলে কখনও অবহেলা করতেন না। আজও কখনও কখনও আমার সেই প্রিয় অধ্যাপকের মুখ স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে। অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী আমাকে পছন্দ করতেন, আমি কবিতা লিখি বলে। তিনি কী করে যেন জানতে পেরেছিলেন আমার এই গোপন কাজটির কথা। এ প্রসঙ্গে আমি পরে বলব। আমার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, এসএম আলী এবং সাবের রেজা করিম। একদিন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর হাতে আমি জীবনানন্দ দাশের 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' বইটি দেখতে পাই। জীবনানন্দ দাশের নাম আমার কাছে তখন অচেনা ছিল। কিন্তু বইটির নাম আমার খুব ভালো লেগেছিল। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কাছে বইটি ধার চাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। তিনি সেদিন বলেছিলেন, 'এক শর্তে বইটি দিতে পারি। কাল সকালেই বইটি ফেরত দিতে হবে। এই বই আমার নয়, কল্যাণ দাশগুপ্তের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।' আমি এ শর্ত পালন করতে রাজি হলাম। বইটি বিকালেই পেয়েছিলাম এবং বাড়িতে এসে 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'র পাতায় মনোনিবেশ করলাম। কোনও মতে আম্মার পরিবেশিত খাদ্য জঠরে চালান করে সেই কবিতার বই পড়তে শুরু করলাম। আজও মনে পড়ে, সারা রাত জেগে ধূসর পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলো পড়েছিলাম। এ রকম কবিতা আমি আগে কখনও পড়িনি। এরপর থেকেই আমি জীবনানন্দ দাশের অনুরক্ত ভক্ত হয়ে পড়ি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী নিজে কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতা কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত 'সওগাত' পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এ কথা আমি ইতোমধ্যে জাতে পেরেছিলাম। তাঁর কবিতায় একটি রোমান্টিক সুর ফুটে উঠত। তিনি তাঁর দু'তিন সহপাঠীর কাছে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। আমি নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে মনে লজ্জা পেতাম। ফলে কারও সামনে কবিতা পড়ার লোভের টুঁটি চেপে ধরেছি বারবার।… আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে অনেক গাফিলতি করেছি। পরীক্ষা-লাজুক ছিলাম আমি। বেশ কিছুটা খামখেয়ালি করেছি এবং একাধিকবার পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে পড়েছি কী এক অজানার টানে। আমার এই খামখেয়ালিপনা এবং অস্থিরতার ফলে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ডিগ্রি হাসিল করার সৌভাগ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিএ পাস করে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়ে পার্ট-ওয়ান পরীক্ষায় সফল হই। আমি সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলাম প্রায় বইয়ের পাতার সঙ্গে সখ্য স্থাপন না করেই। সেবার প্রথম শ্রেণী কেউই অর্জন করেনি। সেকেন্ড পার্ট দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার হলে পা রাখিনি। এভাবেই একটি ছেঁড়াখোঁড়া ছাত্রজীবন শেষ করতে হয়েছে আমাকে। পরীক্ষা না দেওয়ার ফলে আমার চেয়ে বয়সে ছোট বেশ কয়েকজন উজ্জ্বল ছাত্রেরই সহপাঠী হতে হয়েছে আমাকে। তাঁদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিতেরও সহপাঠী হয়েছি আমি। 
পরীক্ষায় কৃতিত্বের ঝলক দেখাতে না পারলেও কবিতা রচনার ক্ষেত্রে আমার কিছু সাফল্য ধরা পড়েছিল সে-সময়ে কারও কারও কাছে। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী আমার লেখায় একজন ভালো কবির আভাস পেয়েছিলেন_ এ কথা আমি বুঝতে পারি তাঁর উদার আচরণে। মনে পড়ে, একদিন দুপুরে তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে তাঁর বাসার দিকে রওনা হন। তাঁর বাসা ছিল ওয়ারীতে। তিনি সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতেন। তিনি সেদিন সাইকেলে সওয়ার না হয়ে পুরো রাস্তাই সাইকেল হাতে করে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাসায় পৌঁছেন। চলার পথে তিনি ফুলবাড়িয়া স্টেশনের রেল লাইনে রাখা কিছু বাতিল রেলওয়ের ওয়াগনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাকে বলেন, 'দেখ মানুষের কী দুর্ভোগ।' আমি ওয়াগনের দিকে তাকিয়ে দেখি ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে ক'জন নারী, পুরুষ এবং শিশু ওয়াগনের ভেতর বসে আছে। এরা সবাই রিফিউজি, যারা বিহার থেকে ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব ওয়াগনের ভেতরেই এরা দিনরাত কাটাচ্ছে। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী বললেন, 'এসো আমরা দু'জনই এদের নিয়ে কবিতা লিখি।' চামড়া-পোড়ানো, চোখ-ঝলসানো রোদ্দুরের ভেতর দিয়ে আমার প্রিয় অধ্যাপক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর বাসার দিকে এগুনোর পথে ওয়াগনের বাসিন্দাদের কথা, ওদের দুর্দশার কথা ভাবছিলাম। শিক্ষকের কবিতা লেখার প্রস্তাব তখন আমার ভাবনা থেকে গায়েব। স্যারের বিনীত ড্রইংরুমের চেয়ারে বসে এক গ্গ্নাস পানি গলায় চালান করে, দুটো সন্দেশের সৎকার সেরে, ফ্যানের হাওয়া খেয়ে বেশ তৃপ্তি হলো। ঘরের চার দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো অনেকগুলো র‌্যাকে সাজানো বই আর বই। দেখে চোখ-প্রাণ ঔৎসুক্যে, লোভে চকচক করছিল, অনুভব করছিলাম। স্যার নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলেন। তিনি সুন্দরভাবে বললেন, 'তোমার জন্য অবাধ আমার লাইব্রেরি। এখানে বসে ইচ্ছেমতো বই পড়তে পার। ইচ্ছে হলে বই বাড়িতেও নিয়ে যেতে পার। আমার তরফ থেকে কোনও বাধা নেই।' আমার শিক্ষকের কথা শুনে মন জুড়িয়ে গেল। তাঁর লাইব্রেরি থেকে বেশ কয়েকটি ভালো বই এনে পড়েছিলাম। তার একটি কি দুটি বই আমার কাছে শেষতক রয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ে। তবে দুঃখের বিষয়, আজ সেই বই আমার বইয়ের ভাণ্ডারে অনুপস্থিত। পুরান ঢাকার পুরনো বাড়িতে দীর্ঘকাল বসবাস করার ফলে আমার অনেক বইয়ের সঙ্গে সেই দুটি বইও বেনো জলে আর কীটের দংশনে নষ্ট হয়ে গেছে। স্যার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ধমকে খুব তাড়াহুড়ো করে একদিন ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। আমার শিক্ষক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর মুখ প্রায়শই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, শুনতে পাই তাঁর কণ্ঠস্বর। কী করে ভুলব তার স্নেহস্পর্শ? তিনি ছিলেন ষোল-আনা অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল। ঢাকার বেশ ক'জন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল। তাঁর ওয়ারীর বাসার ড্রইংরুমে আড্ডায় মিলিত হতেন কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক এবং অধ্যাপকগণ। সেই আড্ডায় শরিক হওয়ার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও আমার সেখানে অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল স্যারের ভালোবাসা এবং ঔদার্য্যের জন্য। … যা হোক, অধ্যাপক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর ড্রইংরুমে একদিন স্বয়ং গৃহকর্তা এবং আমি ওয়াগন বিষয়ে কবিতা পড়লাম। আমার কবিতাটির নাম ছিল 'কয়েকটি দিন, ওয়াগনে'। সৈয়দ নুরুদ্দিন সে কালে একটি উঁচু দরের সাহিত্যপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই সম্ভাব্য পত্রিকার জন্য তিনি লেখা সংগ্রহ করছিলেন। সম্পাদক সৈয়দ নুরুদ্দিন স্যারের কবিতাটি চাইলেন। কিন্তু স্যার তাঁর কবিতা দিলেন না। তিনি সম্পাদককে আমার উপস্থিতিতেই বললেন, 'শামসুর রাহমানের কবিতাটি আপনার পত্রিকার জন্যে নিন। ওর কবিতা আমার কবিতার চেয়ে অনেক বেশি ভালো হয়েছে।' স্যারের এই বিরল ঔদার্য্যে আমি স্তম্ভিত তো হলামই, আমার চোখও ছলছলিয়ে উঠল। সৈয়দ নুরুদ্দিন আমার কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ কবিতাটি চেয়ে নিলেন এবং মানিব্যাগ থেকে পঁচিশ টাকা বের করে আনাড়ি, তরুণ কবিকে দিলেন। সেকালে একটি কবিতার জন্যে পঁচিশ টাকা পাওয়া ছিল মস্ত ব্যাপার। দুঃখের বিষয়, সেই পত্রিকা কখনও দিনের আলো দেখেনি। পরে আমি পঁচিশ টাকা ফেরত দিতে চাইলেও সৈয়দ নুরুদ্দিন সেই টাকা কিছুতেই নিতে চাননি। তারুণ্যের ভোরবেলা লেখা সেই কবিতা অনিল সিংহ সম্পাদিত এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত উন্নতমানের প্রগতিশীল পত্রিকা 'নতুন সাহিত্যে' প্রকাশিত হয়েছিল। আমার এই কবিতায় সোৎসাহে সুর সংযোজন করেছিলেন বন্ধু হামিদুর রহমান। পরে হামিদের ভাই সাঈদ আহমদ সেই সুরটি সেতারে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানে বাজান। সেই কবিতা আখেরে কোথায় হারিয়ে যায়, আমার কোনও কাব্যগ্রন্থেই ওর ঠাঁই হয়নি। জীবনের কত কিছুই তো এভাবে হারিয়ে যায়। কত মুখ, কত না বলা কথা, কোনও কোনও ইতিহাসের উপাদান, এই আমার জীবনেরই কোনও কোনও ঘটনা, যা শত চেষ্টা করলেও ধরা পড়বে না স্মৃতিতে। অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম অধ্যাপক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর কোনও কোনও সংবাদ। তিনি নক্সাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, শিশু-কিশোরদের জন্য ছড়া লিখেছেন, ছড়ার একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর। বইটির নাম মনে পড়ে না। একটি কলেজের অধ্যাপক হয়েছিলেন আমার স্যার। … ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে একটি সুন্দর, শুভ সাংস্কৃতিক আবহাওয়া সঞ্চারিত করেছিল। আমি প্রায়শই এই প্রগতিশীল সংগঠন আয়োজিত অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ পেতাম। নিজের কবিতা তো কয়েকবারই পড়েছি, একবার রবীন্দ্রনাথের 'স্বপ্ন' কবিতাটিও আবৃত্তি করেছিলাম, মনে পড়ে। একবার জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' আবৃত্তি করে পুরস্কার পেয়েছিলাম দুটি বই। তবে সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে আমার জীবনের একটি রোমান্টিক ঘটনা ছড়িয়ে রয়েছে, যার জের চলেছে বহুদিন। সংস্কৃতি সংসদের অনুষ্ঠান শুরু হতো বিকেলের কিছু আগে, সন্ধ্যার বেশ আগেই শেষ হয়ে যেত। অনুষ্ঠানগুলো ছিল সংহত, পরিচ্ছন্ন। অনেক ছাত্র উপস্থিত থাকতেন, নিয়মিত ছয়-সাতজন ছাত্রীও আসতেন। ছাত্রীর জন্য প্রথম সারির বেঞ্চ বরাদ্দ ছিল। প্রথম সারিতে একজনের উপস্থিতি আমার হৃদয়কে আন্দোলিত করত। সেই সুদর্শনার ঈষৎ নীলচে দুটি চোখে এমন কিছু ছিল, যা চুম্বকের মতো কাছে টানত। কিছুদিন নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিলাম ঢের চেষ্টা করে। পরে একদিন সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব উজিয়ে কথা বলে পেললাম ওর সঙ্গে। কী কথা তার সাথে? তাহার সাথে? সেই চিরন্তন কথা যা শুধু ওষ্ট নয়, চোখ দিয়েও বলা যায়। আমার হৃৎস্পন্দন ওর হৃদয়ের উপত্যকাকেও গুঞ্জরিত করে তুলল। ওকে আমি বন্যা বলে ডাকতাম মনে মনে, সাক্ষাতেও। প্রথম দিকে বন্যা ওর বান্ধবীদের নিয়ে বেড়াত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিয়দ্দুরে দীর্ঘ গাছের সারির ছায়াতলে কিংবা রমনা লেকের কিনারে। পরে আমরা দু'জন হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম কোনও ভাঙ্গা মন্দিরের ছায়ায় কিংবা অন্য কোনও জায়গায়, যেখানে অশ্লীল দৃষ্টি অনুপস্থিত। কিন্তু সেখালে আমি বন্যাকে এতটুকু স্পর্শ পর্যন্ত করিনি। দেহাতীত প্রেম কী সম্ভব? আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিলাম দীর্ঘকাল। অনেক বছর পর অবশ্য দয়িতাকে প্রবলভাবে স্পর্শ করেছিলাম কখনও নিরালা ঘরে, কখনও বাইরে জনহীনতায়। সেও তার ভলোবাসা উজাড় করে দিয়েছিল কোনও রকম কার্পণ্য ছাড়াই।’

(তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাপিডিয়া, আত্মজৈবনিক 'কালের ধুলোয় লেখা', শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সালেহ চৌধুরী সম্পাদিত সেরা শামসুর রাহমান, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা : শামসুর রাহমান সংখ্যা, কালি ও কলম : শামসুর রাহমান স্মরণ সংখ্যা, ইন্টারনেট)।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত