প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০১৮, ১১:৫৮

১.
তাঁকে বলা হয় ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’। মানব সেবার মাধ্যমে ভালোবাসার আলোয় যিনি আলোকিত করেছেন পৃথিবীকে, সভ্যতাকে করেছেন মহীয়ান। তিনি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, আধুনিক নার্সিংয়ের অগ্রদূত। ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে লন্ডনে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এই মহীয়সী নারীর, আলোকিত মানুষের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৮২০ সালের ১২ মে জন্মগ্রহণ করেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তা তাকে মানুষের সেবা করার জন্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর তাই তিনি মানুষের সেবায় কাজ করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

২.
বাবা উইলিয়াম এডওয়ার্ড নাইটিঙ্গেল এবং মা ফ্রান্সিস নাইটিঙ্গেলের অভিজাত ইংরেজ পরিবারে ১৮২০ সালের ১২ মে জন্মগ্রহণ করেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। ফ্লোরেন্স শহরের নামানুসারে তার নাম রাখা হয় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। কিশোরী ফ্লোরেন্স ইউরোপ ভ্রমণের সময় জেনেভায় শরণার্থী শিবিরে মানুষের কষ্ট, কাতরতা দেখে এতই আলোড়িত হন যে সিদ্ধান্ত নেন সেবিকা হওয়ার। মা এবং বোনের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এ পেশায় তিনি এসেছিলেন শুধু মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার তীব্র আকাক্সক্ষা থেকে। তিনি শুধু একজন স্ত্রী কিংবা মা হিসেবে তার পরিচিতি সীমাবদ্ধ থাক এটা মেনে নিতে পারেননি। তাই পারিবারিক বাধা সত্ত্বেও কঠোর পরিশ্রম করে তিনি নার্সিংয়ে জ্ঞানার্জন করেন।

৩.
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল (জন্ম : ১২ মে, ১৮২০ – মৃত্যু : ১৩ আগস্ট, ১৯১০) ছিলেন যেমন ছিলেন আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত, তেমনি একজন লেখক এবং পরিসংখ্যানবিদ। আলো হাতে মানবতার পথে হেঁটেছেন যিনি সকল প্রকার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে।অসহায় মানুষের প্রতি অকৃত্রিম প্রেমই তাঁকে এ পথে নামিয়েছিল। 

৪.
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে জানতে আমাদের একটু ইতিহাসের পানে মুখ ফিরে তাকাতে হবে। ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত চলা ক্রিমিয়ার যুদ্ধকে স্মরণে আনতে হবে। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৫৩ সালের অক্টোবর মাসে তুরস্কের নিয়ন্ত্রিত দারদানেলিস প্রণালী দিয়ে যুদ্ধজাহাজ চলাচলের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তুরস্কের খ্রিস্টানদের রক্ষার অজুহাতে অটোমান সাম্রাজ্যের তুর্কি এলাকায় রাশিয়া আক্রমণ চালালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সূচনা হয়। রাশিয়ার সঙ্গে এই যুদ্ধ চলে তুরস্ক তথা উসমানিয়া বা অটোমান সাম্রাজ্যের মিত্রশক্তি ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং সারডিনিয়ার। ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত এই ক্রিমিয়ার যুদ্ধ চলে। রাশিয়া তুরস্কে আক্রমণ চালালে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স তুরস্কের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ১৮৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে মিত্রশক্তি ক্রিমিয়ায় অবস্থিত রাশিয়ার সেভাস্তোপোল নৌঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার নৌশক্তিকে অচল করে দেয়া। দুই মাসের মধ্যে তারা আলমা নদী, বালাকলাভা এবং ইনকারমান এই তিনটি যুদ্ধে জয়লাভ করে। বালাকলাভার যুদ্ধ খুবই সাহসী লড়াই বলে চিহ্নিত, কিন্তু লাইট ব্রিগেডের ৬৭০ জন অশ্বারোহী সৈনিক বিভ্রান্তিকর আদেশের কারণে ভুল করে সরাসরি রাশিয়ার গোলন্দাজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সারডিনিয়া মিত্রজোটে যোগ না দেয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ ১৮৫৫ সালের বসন্তকাল অবধি বন্ধ থাকে। এরপর মিত্রবাহিনী সেভাস্তোপোল দখল করে নেয়। যুদ্ধের চেয়ে রোগে ভুগেই এ যুদ্ধে বেশি সৈন্যের ক্ষতি হয়।
 
৫.
যুদ্ধের এ ভয়াবহতা, মানুষের বাঁচার আকুতি নাড়া দেয় ফ্লোরেন্সকে। অপ্রতুল চিকিৎসাসেবা ও সৈন্যদের দুরবস্থার মধ্যে ৩৮ জন সেবিকাসহ সেবার আলো হাতে পাশে এসে দাঁড়ান তিনি। তাদের জন্য অস্থায়ী হাসপাতাল গড়ে তোলেন। ফ্লোরেন্স দিনের বেলা আহতদের সেবা করে রাতে মোমবাতি হাতে তাদের খোঁজখবর নিতেন। সেই থেকে তার নাম হয়ে গেল ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’। 

৬.
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ১৮৫৩ সাল থেকে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের ‘কেয়ার অব সিক জেন্টলওমেন ইনিস্টিটিউটের’ তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে কাজ করেছেন। ১৮৫৫ সালে তিনি নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য কাজ শুরু করেন। নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৫৯ সালে তিনি নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতবর্ষের গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর গবেষণা চালান। যা ভারতবর্ষে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবদান রাখে। ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৮৫৯ সালে তিনি ‘রয়্যাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটির’ প্রথম সারির সদস্য নির্বাচিত হন। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শেষে ইংল্যান্ডের রানি তাকে ‘নাইট’ উপাধিসহ অনেক অর্থ পুরস্কার হিসেবে প্রদান করেন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল সেই অর্থ দিয়ে লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশারূপে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং । এই ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের মানবতার সেবায় কাজ করার শুরুতেই তিনি শপথবাক্য পাঠ করাতেন যা এখন ‘নাইটিঙ্গেল প্লেজ’ নামে পরিচিত। ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সাথে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় নার্সিংয়ের উপর বইও লিখেছেন।

৭.
তিনি অসংখ্য পদক আর উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ১৮৮৩ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান করেন। প্রথম নারী হিসাবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি। এ ছাড়াও ১৯৭৪ সাল থেকে তাঁর জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’। যার মধ্যেমে সম্মান জানানো হয় এক নারীকে যিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন- নার্সিং একটি পেশা নয় সেবা। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদার মাধ্যমে পালন করা হয় দিবসটি।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত