প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

রামতনু লাহিড়ী

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩৪

১.
রামতনু লাহিড়ী ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত মানুষ। শিক্ষাবিদ, সমাজ-সংস্কারক এবং নারী-স্বাধীনতার প্রবক্তা হিসেবে উনিশ শতকে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। গুরু ডিরোজিওর সান্নিধ্যে এসে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে তিনি গ্রহণ করেছিলেন ইহলৌকিক, যুক্তিবাদী এবং মানবকল্যাণমুখী ভাবধারা। উনিশ শতকের কলকাতায় তাঁকে বলা হতো Arnold of Bengal. রামতনু লাহিড়ী ১৮৯৮ সালের ১৩ আগস্ট কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। মহাপ্রয়াণ দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। রামতনু লাহিড়ীর জন্ম ও প্রয়াণ দিন, তারিখ নিয়েও নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য খুঁজে পেলেও আমি উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত মানুষ রামতনু লাহিড়ীর সঠিক জীবনেতিহাস পাই পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী রচিত ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, রামতনু লাহিড়ী সম্পর্কে আমি প্রথম জানতে পারি কলেজ জীবনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে। তাঁকে জানার আগ্রহ তীব্রতর হলে পাঠাগারে আরো কিছু বই-পত্র খুঁজি এবং কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘সেই সময়’ পাঠ করলে অনেক অষ্পষ্ট বিষয় সহজ-সরলভাবে ফুটে ওঠে, নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাই।

২.
রামতনু লাহিড়ী (জন্ম : মে ২২, ১৮১৩ – মৃত্যু : আগস্ট ১৩, ১৮৯৮ ) তাঁর ছাত্রদের হিতোপদেশ অপেক্ষা বুদ্ধি ও নীতির দ্বারা বেশি প্রভাবিত করেন। সরকারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে তিনি বাংলার বিভিন্ন স্কুলে বদলি হয়েছেন। সর্বত্রই তিনি তাঁর ছাত্র এবং সহকর্মীদের দ্বারা একজন আদর্শ শিক্ষক, জ্ঞান ও চিন্তার নতুন উৎস এবং একজন অসাধারণ সংগঠক হিসেবে অভিনন্দিত হয়েছেন। তিনি তাঁর শিক্ষা, একাগ্রতা, পুনর্জাগরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দিক নির্দেশনার দ্বারা ছাত্রদের একটি প্রজন্ম তৈরি করেন, যাঁরা পরবর্তীকালে শিক্ষা, রাজনীতি, সাংবাদিকতা এবং অন্যান্য পেশায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। শিক্ষক, সংস্কারক, সংগঠক রামতনু লাহিড়ী ব্রাহ্মধর্মের প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। 

৩.
উনিশ শতকে হিন্দু কলেজকে (১৮১৭) কেন্দ্র করে দেখা দিয়েছিল নবজাগরণের উত্তুঙ্গ এক রূপ। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের আলোয় স্নাত হয়ে হিন্দু কলেজে প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের (১৮২৬) সদস্যবৃন্দ কলকাতার রক্ষণশীল সমাজে প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি
করেন। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন বা ইয়ং বেঙ্গলের অভিঘাতে কলকাতার সমাজজীবনে সৃষ্টি হয় যে নবতরঙ্গ, তার মুখ্য প্রেরণা-উৎস ছিলেন হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষক হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১)। রেনেসাঁস ম্যান বা আলোকিত মানুষ বলতে যা বোঝায়,
ডিরোজিও ছিলেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ। রামতনু লাহিড়ী ছিলেন এই ডিরোজিওর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাবশিষ্য। ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থের ভূমিকায় শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন - ‘ডিরোজিওর ছাত্রবৃন্দের মধ্যে যদি কেহ গুরুর সমগ্র-ভাব পাইয়া থাকেন, যদি কেহ চিরদিন গুরুকে হৃদয়াসনে প্রতিষ্ঠিত রাখিয়া পূজা করিতে থাকেন, তবে তাহা রামতনু লাহিড়ী।’ যেহেতু ইয়ং বেঙ্গলদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজে প্রচলিত সনাতন কুসংস্কার ও জগদ্দল রক্ষণশীলতা, তাই রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাদের বিরুদ্ধে নানাপ্রকার কুৎসা ও অপবাদ ছড়াতে থাকে, তাদের চরিত্রে লেপন করতে থাকে নানা ধরনের কালিমা। তৎকালীন ডামাডোল, তর্ক-বিতর্ক ও বিপরীতমুখী প্রচারণা থেকে প্রকৃত সত্য বের করে আনা ছিল এক কঠিন কাজ। এ কাজেই ব্রতী হলেন শিবনাথ শাস্ত্রী।’রামতনু লাহিড়ীর জীবনচরিত লিখতে গিয়ে সে-সময়ের প্রকৃত সত্য উপস্থাপন করাই হয়ে উঠলো তাঁর মৌল লক্ষ্য। সে-লক্ষ্য পূরণে একজন লেখক যে কী পরিমাণে সিদ্ধি লাভ করতে পারেন তার উজ্জ্বল ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে আলোচ্য গ্রন্থ। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় লেখকের এই বক্তব্য : ‘আমার পূবর্ববর্তী কোনও কোনও লেখক ডিরোজিও ও তাহার শিষ্য-দলের প্রতি বিশেষ অবিচার করিয়াছেন। তাঁহারা ইহাদিগকে নাস্তিক ও সমাজ-বিপ্লবেচ্ছু যথেচ্ছচারী লোক বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। এরূপ অমূলক অপবাদ আর হইতে পারে না। ডিরোজিওর ছাত্রবৃন্দের মধ্যে যদি কেহ গুরুর সমগ্র-ভাব পাইয়া থাকেন, যদি কেহ চিরদিন গুরুকে হৃদয়াসনে প্রতিষ্ঠিত রাখিয়া পূজা করিতে থাকেন, তবে তাহা রামতনু লাহিড়ী। পাঠক! এই গ্রন্থে দেখিবেন ঈশ্বরে তাঁহার কি বিমল ভক্তি ছিল। আমাদের গৃহে যখন তিনি বাস করিতেন, তখন সর্বদা দেখিতাম যে, অতি প্রত্যুষে তিনি উঠিয়াছেন, এটি ওটি করিতেছেন এবং গুন্গুন্ স্বরে গান গাইতেছেন, ‘মন সদা কর তাঁর সাধনা’। আমার বিশ্বাস এই সাধনা তাঁর নিরন্তর চলিত। এই কি নাস্তিক গুরুর নাস্তিক শিষ্য? অতএব প্রকৃত অবস্থা কি, তাহা দেখাইয়া ইঁহাদিগকে অকারণ অপবাদ হইতে রক্ষা করাও আমার অন্যতর উদ্দেশ্য। কিন্তু তাহার ফল চরমে যাহা দাঁড়াইয়াছে তাহা সকলেই অনুভব করিবেন। স্থানে স্থানে বাহিরের কথা প্রকৃত বিষয় অপেক্ষা অধিক হইয়া পড়িয়াছে।’

৪.
রামতুন লাহিড়ী ১৮১৩ সালের ২২ মে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে এক কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা হিন্দু কলেজএ শিক্ষা লাভ করেন। রামতনু লাহিড়ী সেসব শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীর একজন ছিলেন, যাঁরা উনিশ শতকে বাংলায় বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলনের ভিত তৈরি করেছিলেন। নানা দিক থেকে উনিশ শতককে বলা যায় স্কুল শিক্ষকদের যুগ। তখন হেনরি ডিরোজিও থেকে শুরু করে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচরণ সরকার, পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী এবং ডেভিড হেয়ার পর্যন্ত বিখ্যাত স্কুল শিক্ষকগণ বাংলায় এক নবজাগরণের সৃষ্টি করেন। শিক্ষক হিসেবে রামতনু ছিলেন সে যুগের একজন আদর্শ প্রতিনিধি। 

৫.
রামতনুর পিতা রামকৃষ্ণ লাহিড়ী ছিলেন নদীয়ারাজের একজন দেওয়ান। এগারো বছর বয়স পর্যন্ত রামতনু গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া করেন। পরে তিনি অগ্রজ কেশবচন্দ্র লাহিড়ীর সঙ্গে কলকাতা যান এবং ডেভিড হেয়ারের পৃষ্ঠপোষকতায় হেয়ার স্কুলে বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ পান। ১৮২৮ সালে তিনি বৃত্তি নিয়ে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বাংলার অন্যতম বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডিরোজিওর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৮৩৩ সালে রামতনু হিন্দু কলেজের শিক্ষক হন এবং ১৮৪৬ সালে সরকারি কৃষ্ণনগর কলেজে যোগদান করেন। ওই বছরই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। রামতনু তাঁর দীর্ঘ শিক্ষক জীবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করেছেন। সবশেষে বরিশাল জিলা স্কুলে প্রধান শিক্ষক থাকাকালে ১৮৬৫ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। 

৬.
রামমোহনের প্রভাবে রামতনু পৈতা ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। এ কারণে তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই সামাজিকভাবে অপমানিত হতেন। কিন্তু শিক্ষিত ব্যক্তিরা তাঁকে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে এবং তাঁর অনুপম চরিত্রের জন্য গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর শিষ্যরা তাঁকে তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও অত্যন্ত সম্মান করতেন। শিষ্যদের অন্যতম শিবনাথ শাস্ত্রী ১৯০৪ সালে রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ নামে নিজের সমাজ-সমীক্ষামূলক গবেষণা গ্রন্থের নামকরণের মাধ্যমে গুরুকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। 

৭.
১৯০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথম প্রকাশিত হয় শিবনাথ শাস্ত্রীর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’। বাংলা ভাষার যেসব গ্রন্থ শতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে উত্তরকালীন মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ ঠিক এমন একধরনের বই। রামতনু লাহিড়ীর ব্যক্তিজীবন আলোচনা-সূত্রে গোটা উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি আর রামতনু লাহিড়ীর জীবন ছিল অভিন্ন। শিবনাথ শাস্ত্রী ব্যক্তি রামতনু লাহিড়ী ও নবজাগ্রত উনিশ শতকী বাংলাদেশকে অভিন্ন দৃষ্টিতে এই গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন। উনিশ শতকের এমন একজন আলোকিত মানুষকে শিবনাথ শাস্ত্রী অসামান্য নিপুণতার সঙ্গে আলোচ্য গ্রন্থে উদ্ভাসিত করে তুলেছেন। অন্যের সংস্পর্শে এসে রামতনু লাহিড়ী কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছেন সে-কথা যেমন এখানে আছে, তেমনি আছে রামতনু লাহিড়ীর সংস্পর্শে আসা বিভিন্ন মানুষর চারিত্রিক রূপান্তরের কথা। 

৮.
আমরা জেনেছি, রামতনু লাহিড়ী এবং উনিশ শতকী বাঙালির নবজাগরণকে সমান্তরাল দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে শিবনাথ শাস্ত্রী রচনা করেছেন ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’। রামতনু লাহিড়ীর ব্যক্তিজীবন উপস্থাপন সূত্রে শিবনাথ শাস্ত্রী এই গ্রন্থে নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন উনিশ শতকী উন্মথিত বাঙালির জাগরণ-ইতিহাস। কেবল উনিশ শতকী সমাজ নয়, সমকালীন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কেও এখানে পাওয়া যাবে শিবনাথ শাস্ত্রীর বিশ্লেষণাত্মক মূল্যায়ন। গ্রন্থটি কেবল উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত মানুষ রামতনু লাহিড়ীর জীবনেতিহাস নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে ওই শতকের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও রেনেসাঁস-আন্দোলনের ঐতিহাসিক এক দলিল। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষ্য : ‘...অগ্রে ভাবিয়াছিলাম বিশেষভাবে তাহার [রামতনু লাহিড়ী] অনুরক্ত ব্যক্তিগণের জন্য একখানি ক্ষুদ্রাকার জীবনচরিত লিখিব।... অতএব, প্রথমে তদ্নুরাগী লোকদিগের জন্যই লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম। কিন্তু তৎপরে মনে হইল, লাহিড়ী মহাশয়ের যৌবনের প্রথমোদ্যমে রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার ও ডিরোজিও, নব্যবঙ্গের এই তিন দীক্ষাগুরু তাঁহাদিগকে যে মন্ত্রে দীক্ষিত করেন, সেই মন্ত্রের প্রভাবেই বঙ্গসমাজের সবর্ববিধ উন্নতি ঘটিয়াছে; এবং সেই প্রভাব এই সুদূর সময় পর্যন্ত লক্ষিত হইতেছে। আবার সেই উন্নতির স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছেন, অগ্রসর হইয়া অত্যগ্রসর দলের সঙ্গে মিশিয়াছেন, এরূপ দুই একটি মাত্র মানুষ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে লাহিড়ী মহাশয় একজন। অতএব, তাঁহার জীবনচরিত লিখিতে গেলে, বঙ্গদেশের আভ্যন্তরীণ ইতিবৃত্তকে বাদ দিয়া লেখা যায় না। তাই বঙ্গদেশের আভ্যন্তরীণ সামাজিক ইতিবৃত্তের বিবরণ দিতে প্রবৃত্ত হইতে হইল।’

৯.
বাংলা তথা উপমহাদেশের কথাসাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক কিংবদন্তী কথাশিল্পী, অবিসংবাদিত উচ্চারণ, দীপ্ত কণ্ঠস্বর ও অক্ষয় নক্ষত্র। কথাসাহিত্য ও ইতিহাসের অপূর্ব সংমিশ্রণ এবং শিল্পনৈপুণ্যের অলৌকিক ক্ষমতায় তিনি সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ ও কালজয়ী সব উপন্যাস। ‘সেই সময়’ তাঁর এমনই একটি ইতিহাসধর্মী উপন্যাস। এই উপন্যাসের মূল নায়ক সময়, একটি বিশেষ সময় - যেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ঘটনা ও চরিত্রগুলো চিত্রিত। উপন্যাসের ভূমিকাতেই বলা আছে, “একটি বিশেষ সময়ই এই উপন্যাসের মূখ্য চরিত্র। নাটকের শুরুতে যেমন দেওয়া থাকে পাত্রপাত্রীদের নাম ও পরিচয়, তেমনভাবে যদি গোড়াতেই দেয়া থাকতো এই বিপুল বর্ণাঢ্য উপন্যাসের চরিত্রাবলীর নাম, সত্যিই বিস্ময়কর মনে হত সেই তালিকা। মাইকেল, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, হেয়ার সাহেব, দেবেন ঠাকুর - কে নেই! সমস্ত ঊনবিংশ শতাব্দীই এই উপন্যাসে যেন নানান চরিত্র হয়ে চোখের সামনে জীবন্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বহু পরিশ্রমে, ধূলিমলিন পৃষ্ঠা ঘেঁটে প্রায় গবেষকের মতোই হাজির করেছেন সেই সময়কে। শুধু যেটুকু তফাৎ তা হল, গবেষকের রচনার মধ্যে প্রাণ থাকে না, তিনি সেই প্রাণটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।” ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি (১৮৪০-১৮৭০) সময়কালই এই উপন্যাসের উপজীব্য। ঐ-সময়কালে ইংরেজশাসিত পরাধীন অখণ্ড বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষে যে-সমস্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী ঘটেছে, সে-সবের আলোকেই সুনীল ‘সেইসময়’ উপন্যাস রচনা করেছেন। উপন্যাসের ভূমিকাতেই লেখক বলেছেন, “ আমার কাহিনীর পটভূমিকা ১৮৪০ থেকে ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দ। এবং এই কাহিনীর মূল নায়কের নাম সময়। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে ১৮২৫ থেকে ১৮৪৫ খ্রীস্টাব্দ সময়কে বঙ্গের নবযুগ বলেছেন। এই নবযুগেরই পরবর্তীতে নাম হয় ‘বেঙ্গল রেনেশাঁস’। এই রেনেশাঁসের ধারণাটিকেই এই গ্রন্থে নাড়াচাড়া করতে চেয়েছি।”

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, দৈনিক সংবাদ, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত