ওরহান পামুক

প্রকাশ : ০৮ জুন ২০১৮, ১৪:২৬

২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তুর্কি ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্য সম্পাদক, শিক্ষক এবং তুরস্কের অন্যতম প্রধান লেখক ওরহান পামুকের সম্পূর্ণ নাম ফেরিত ওরহান পামুক । ওরহান পামুক ১৯৫২ সালের ৭ জুন জন্মগ্রহন করেন। বিশ্বের ৬০টিরও অধিক ভাষায় তাঁর ১১ মিলিয়নের বেশিসংখ্যক বই বিক্রি হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে তিনি তুরস্কের সবচাইতে অধিক প্রচারিত সাহিত্যিক হিসেবে পরিণত হয়েছেন।

পামুক বলেন "ত্রিশ বছর যাবৎ আমি ফিকশানধর্মী কাজ করছি। প্রথম দশ বছর চিন্তিত ছিলাম অর্থসংস্থান নিয়ে। এবং তখন কেউ আমার কাছে কখনো জানতে চায়নি, কী পরিমাণ টাকা আমি রোজগার করি। দ্বিতীয় দশকেও কেউ এ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন আমাকে করেনি। শেষ দশ বছরে আমি অনেক টাকা ব্যয় করেছি এবং অনেকেই জানতে চেয়েছেন কীভাবে আমি এত টাকা ব্যয় করেছি, কিন্তু এর উত্তর তো আমি দেব না"। আন্তর্জাতিক ডাবলিন সাহিত্য পুরস্কার-২০০৩ পাওয়ার পর এক প্রশ্নের উত্তরে তুরস্কের নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুক কথাগুলো বলেছিলেন। আর এ উক্তি আমাদের নির্দ্বিধায় মনে করিয়ে দেয়, তুরস্কের সমাজব্যবস্থায় একটা বড় ধরনের সমস্যা বিদ্যমান। যাহোক, পাঠক নিশ্চয় জানেন, পামুক সম্পর্কে কোনো বড় ভূমিকার প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্বসাহিত্যের একজন পুরোধা ঔপন্যাসিক; আধুনিক-উত্তর সময়ে যাঁর উত্থান। ইতিহাস, সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, পরমতসহিষ্ণুতা, জীবন-বাস্তবতা ইত্যাদি নানা বিষয়কে তিনি একটি ক্যানভাসে নিয়ে এসে তাঁর উপন্যাসে উপস্থাপন করেন। বোর্হেস, মার্কেজ, ফকনার, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয় ও কাজী নজরুল তাঁর প্রধান প্রেরণা।

ইস্তামবুলে জন্ম নেয়া ওরহান পামুক দ্য হোয়াইট ক্যাসল, দ্য ব্ল্যাক বুক, দ্য নিউ লাইফ, মাই নেম ইজ রেড, স্নো ও দ্য মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স এর রচয়িতা। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ছাড়াও (নোবেল প্রাপ্ত প্রথম তুর্কি) পামুক অজস্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ইউরোপিয়ান রাইটার্স পার্লামেন্ট (ইউরোপিয় লেখকদের সংসদ) পামুক এবং হোসে সারামাগো'র যৌথ প্রস্তাবনার ফসল।

বিখ্যাত লেখক বা চিন্তকেরা এক ডুবে সমাজের তলদেশ থেকে মৌলিক বিষয়াবলিকে তুলে নিয়ে আসেন। পামুকও এর ব্যতিক্রম নন। সমাজের বিভিন্ন মৌলিক সমস্যাসমূহকে পামুক তাঁর আলোচনায় প্রাধান্য দিয়েছেন। 'স্নো' উপন্যাসটিতে তিনি দেখিয়েছেন আধুনিক তুরস্কে বিরাজমান ইসলামবাদ ও পাশ্চাত্যবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। কার্স নামক সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চলে এ গল্পের পটভূমি। কা একজন উদ্বাস্তু তুর্কি কবি। তুষারময় নগরী কার্সে থাকাকালে কিছু ইসলামপন্থি গোড়া জনসাধারণ, আইনপ্রণেতা ও সেই সাথে কিছু প্রগতিশীল লোকের নানান ঘোর-প্যাঁচে পড়ে যান তিনি। এক সময় বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ ঘটনা ও গোঁড়া দ্বান্দ্বিক আদর্শের জের ধরে দুই আদর্শধারী লোকজনের মধ্যেই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। বৃহত্তর মানবকল্যাণকে পাশ কাটিয়ে যেসব নোংরা ও গোঁড়া আদর্শসমূহকে আমরা নিজেদের মধ্যে লালন করছি, তার-ই এক বাস্তব চিত্র এ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। আর পামুকের স্বীয় কথা বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় -তিনি তাঁর এ বইয়ে প্রাণশক্তির উৎসের সন্ধান করেছেন রাজনীতির মাঝে। যেমন মাই নেম ইজ রেড-এর বেলায় একই উপাদান অন্বেষণ করেছিলেন শিল্পে অন্তর্নিহিত সাংস্কৃতিক সত্যের মধ্যে। ২০০৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস 'স্নো' উপন্যাসটিকে বিশ্বের সেরা দশটি উপন্যাসের একটি বলে আখ্যায়িত করে।

২০০৫ সালে পামুক বিতর্কিত হয়ে ওঠেন তুরস্কের সরকারের কাছে। তিনি কেন বিতর্কিত হয়েছিলেন জানতে হলে ফিরে যেতে হবে শ'খানেক বছর আগের ইতিহাসে। তখন মানে ১৯১৪ সালে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের পক্ষ নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয় তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্য, আর্মেনীয়রা যে সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। যুদ্ধ চলাকালে অটোমান কর্তৃপক্ষ আর্মেনীয়দের ‘ঘরের শত্রু’ বলে প্রচারণা চালাতে থাকে। ১৯১৫ সালের ২৪ এপ্রিল অটোমান সরকারের শত্রু বলে সন্দেহে আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের কয়েকশ নেতা ও বুদ্ধিজীবীকে কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বন্দি করা হয়। পরবর্তীতে তাদের বেশির ভাগকেই হত্যা করা হয়। কাউকে কাউকে দেওয়া হয় নির্বাসন। আর্মেনীয়রা ওই ২৪শে এপ্রিল দিনটিকেই গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। আর্মেনীয়রা দাবি করে, ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে তাদের ১৫ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। অটোমান সাম্রাজ্যে এই আর্মেনীয় গণহত্যা সম্পর্কে মন্তব্য করায় ২০০৫ সালে তুরস্কে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। পামুকের নিজস্ব বক্তব্য, জন্মভূমিতে বাক স্বাধীনতার অভাবের প্রতি আলোকপাত করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এর ফলশ্রুতিতে মিছিলে তাঁর বই পোড়ানো হয়। তাঁকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত