বুদ্ধদেব বসু

প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০১৮, ১৮:৩২

 

কবিগুরু রবিঠাকুরের পর বুদ্ধদেব বসুই বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব্যসাচী লেখক। অাজ বুদ্ধদেব বসুর প্রয়াণ দিবস। রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তিনিই প্রধান নির্মাতা। রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিনি ও সমকালীন সাহিত্যিক-শিল্পীরা পাশ্চাত্য সাহিত্য নিংড়ে গ্রহণ করেছিলেন প্রেরণার উৎস। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ এই দর্শন মূর্ত হয়ে উঠেছিল তাঁদের সাহিত্যকর্মে। সাহিত্যের প্রায়োগিক মূল্য কখনো উন্নত সাহিত্যের মানদণ্ড হতে পারে না- এই ছিল বুদ্ধদেব বসুর আজন্মলালিত বিশ্বাস।

সাহিত্যিক, সমালোচক, সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারের আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগরে। জন্মের অল্প পরেই ধনুষ্টংকারে তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটে এবং পিতা ঢাকা বারের উকিল ভূদেবচন্দ্র বসু পরিব্রজ্যা গ্রহণ করে নিরুদ্দেশ হন। এমতাবস্থায় বুদ্ধদেব মাতুলালয়ে লালিত-পালিত হন। তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কাটে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ঢাকায়।

বুদ্ধদেব বসু শিক্ষাজীবনে বরাবর অসাধারণ ফলাফল করেছেন। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯২৫), ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ (১৯২৭) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ (১৯৩০) ও এমএ (১৯৩১) ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনের প্রথমভাগে তিনি কলকাতার রিপন কলেজে অধ্যাপনা (১৯৩৪-১৯৪৫) করেন। ১৯৪৪-১৯৫১ সময় পর্বে তিনি স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। এরপর একে একে তিনি আমেরিকার পেনসিলভানিয়া কলেজ ফর উইমেন্স (১৯৫৩-১৯৫৪), কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৬-১৯৬৩), আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রুকলিন কলেজ, কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের সামার স্কুল, ব্লুমিংটনে ইলিনয়ের ওয়েসলিয়ান কলেজ ও হনুলুলুতে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬৩-১৯৬৫) অধ্যাপনা করেন। ১৯৬১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শরৎ বক্তৃতামালা’ প্রদান করেন।

ঢাকা থেকে প্রগতি (১৯২৭-১৯২৯) এবং কলকাতা থেকে কবিতা (১৯৩৫-১৯৬০) পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কর্ম। কবিতাবিষয়ক কবিতা পত্রিকাটি তখন সাহিত্যিক মহলে উচ্চ প্রশংসা লাভ করে; রবীন্দ্রোত্তর কবিতা-আন্দোলনেও এর ভূমিকা স্বীকৃত। বুদ্ধদেব নিজেও রবীন্দ্র-প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে আসেন।

বুদ্ধদেব বসু বিশ্বাস করতেন, শিল্পসাহিত্যের কোনো সামাজিক উপযোগিতা বা লক্ষ্য থাকতে পারে না। এ কালের শিল্পীসমাজ বিচ্ছিন্ন। শার্ল বোদলেয়ার তাঁর কবিতার ভূমিকায় বলেছেন: ‘যে মধ্য-উনিশ শতকে ইংল্যান্ডে উপযোগবাদের অভ্যুদয় হলো, সেই সময়ে বোদলেয়ার ঘোষণা করেন যে কবি কোনো "কাজে লাগেন না"। বায়রনি বিদ্রোহের দিন গত হয়েছে, পূর্ণ হয়েছে সমাজের সঙ্গে কবির বিচ্ছেদ; প্রতিবাদ করলেও প্রতিবাদের পাত্রকে স্বীকার করে নিতে হয়, অতএব, একমাত্র যা সহনীয় ও সম্ভব তা উপেক্ষা ও স্বেচ্ছাবৃত নির্বাসন।’ এই বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শোনা যায় কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠেও। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ২৪ মে ১৯৪১ সালে বুদ্ধদেবকে প্রেরিত একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘আমরা এই ইতিহাসের দ্বারাই একান্ত চালিত এ-কথা বারবার শুনেছি এবং বারবার ভিতরে ভিতরে খুব জোরের সঙ্গে মাথা নেড়েছি। এ তর্কের মীমাংসা আমার নিজের অন্তরেই আছে, যেখানে আমি আর কিছু নই—কেবলমাত্র কবি। সেখানে আমি সৃষ্টিকর্তা, সেখানে আমি একক, আমি মুক্ত। বাহিরের বহুতর ঘটনাপুঞ্জের দ্বারা জালবদ্ধ নই।’

উপযোগিতামূলক সাহিত্য রচনার বিরোধী ছিলেন বলে বুদ্ধদেব এবং তাঁর সঙ্গীরা অভিহিত হয়েছিলেন ‘পলায়নবাদী’ হিসেবে। এই অভিযোগ অসামান্য যুক্তিনিষ্ঠায় তিনি খণ্ডন করেছিলেন ‘পলায়ন’ প্রবন্ধে: ‘আমি যদি কবি হই তাহলে কবি হিসেবে আমার কর্তব্য ভালো কবিতা লেখা, তা ছাড়া কিছু নয়, জীবনের সঙ্গে সেই আমার যোগসূত্র। আমি যদি বাণিজ্য কি রাজনীতি সম্বন্ধে মূঢ় হই, ফুটবল কি ঘোড়দৌড়ের খবর না রাখি তাহলে ক্ষতি কি? আমি বরং বলবো, ভালো কবিতা লেখবার জন্যে যে-রকম জীবন আমার নিজের পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল বলে জানি আমি চাইবো আমার জীবনকে সে-ভাবেই গড়তে, সেটা এস্কেপিজম নয়, সেটা শুভবুদ্ধি। এখানেও কবিতে কবিতে প্রভেদ হবে; কেউ চাইবেন নির্জন আত্মনিমগ্ন জীবন, কেউ বা সামাজিক জীবনের জটিলতা, অন্য কেউ হয়তো “ছাত্র আর মজুরের উজ্জ্বল মিছিল” থেকে প্রেরণা পাবেন—বেশির ভাগই কখনো এদিক কখনো ওদিক ঝুঁকবেন; সম্পূর্ণ আত্মসংহত কি সম্পূর্ণ বহির্ব্যাপ্ত কোন কবিই বোধ হয় নন, তবে বিশেষ এক দিকে পক্ষপাত সকলেরই ধরা পড়ে—সাহিত্যেও অভ্যন্তরীণ তাগিদ হিসেবে ও সবেরই সমান মূল্য, এর মধ্যে বিশেষ কোন-একটিকে গ্রহণ না-করাটাই পলায়নী মনোবৃত্তি এ-কথা বললে আর যা-ই হোক সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু বলা হয় না।’

সাহিত্যকে প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক লক্ষ্য সাধনের অস্ত্র করে তোলার তীব্র বিরোধী বুদ্ধদেবকে আমরা ভিন্নরূপে আবিষ্কার করি ১৯৪২ সালে। সেই সময় ঢাকায় কমিউনিস্ট কর্মী ও তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ দাঙ্গাবাজদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এই নারকীয় ঘটনার প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে বুদ্ধদেব ‘প্রতিবাদ’ নামে একটি তাৎপর্যমণ্ডিত কবিতা লিখেছিলেন:
‘ক্ষমা? এরও কি ক্ষমা আছে? এ-উন্মত্ত হননবৃত্তিরে
নীরবে সহিতে পারে এত বড়ো মানব মহিমা
জানি না সম্ভব কিনা।’
কবিতাটি শেষ করেছিলেন এই সংকল্প ঘোষণা করে—‘পশুত্বের প্রতিবাদে নিখাদে রেখাবে আজ হোক উদ্দীপিতা। আমার কবিতা।’ নজরুল লিখিত ‘প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/ যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ’-এর সঙ্গে বুদ্ধদেবের সাদৃশ্য লক্ষণীয়। শুধু একটি কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি তিনি। ১৯৪২ সালে ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘ’ গঠিত হওয়ার পর সেই সংঘে যোগ দেন বুদ্ধদেব বসু। রচনা করেন ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম’ নামে একটি বলিষ্ঠ প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শুরুতেই বুদ্ধদেব স্বীকার করেছেন রাজনীতি তাঁর জীবনে কখনো আলোচনার বিষয় ছিল না। সাহিত্য সাধনাই তাঁর ‘জীবনের মূল প্রেরণাশক্তি’। ‘নিরিবিলি ঘরের কোণে বসে পড়াশোনো করতে’ ও ‘মাঝে মাঝে এক-আধটা কবিতা লিখতে’ চান তিনি। এ জন্য যে শান্তির প্রয়োজন সেই শান্তি বিপন্ন হয়েছে ‘সংস্কৃতির প্রতিশ্রুত শত্রু’ ফ্যাসিবাদের তাণ্ডবে। তাই ফ্যাসিবাদের মতো একটি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তাঁকে লিখতে হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ ‘মনুষ্যত্বের অবমাননা ও সভ্যতার বিনাশ’-এরই অপর নাম। ‘কমিউনিস্টবিরোধী’ বলে পরিচিত বুদ্ধদেব বসু এই প্রবন্ধে রাশিয়াতে মনুষ্যত্বের পূর্ণ মর্যাদা দান ও সভ্যতার পূর্ণ বিকাশের প্রশস্তি গেয়েছেন। রাজনীতিবিমুখ বুদ্ধদেব অপকটে বলেছেন: ‘শান্তির সময়, সুখের সময় নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব, হয়তো সে অবস্থাই স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল, কিন্তু চারিদিকে যখন অশান্তির আগুন লেলিহান হয়ে জ্বলে উঠে তখন কবি বলো, শিল্পী বলো, ভাবুক বলো কারো পক্ষেই মনের মধুর প্রশান্তি অক্ষুণ্ন রাখা আর সম্ভব হয় না, যার প্রাণ আছে তার প্রাণেই ঘা লাগে।

ফ্যাসিবাদবিরোধী ও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমর্থক বুদ্ধদেব বসুর রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় পাওয়া যায় ‘ফ্যাসিবাদ, শিল্প ও বিশ্বমানব’ প্রবন্ধেও ‘শিল্পীর যেটা সত্য পরিচয় সেটা কখনোই নঞর্থক হতে পারে না; তিনি যে শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে এ-কথা বললে তাঁকে অনেকটা ছোট করে দেখা হয়; তিনি যে প্রেমিক, তিনি যে বিশ্বমানবিক, তিনি যে দেশকালের সমস্ত সংস্কারের উর্ধ্বে, তিনি যে মনুষ্যধর্মের পুরোহিত এটাই তাঁর সম্বন্ধে আসল কথা। ...রোমা রোলাঁর বিখ্যাত বাণী আজ আমরা নিজেদের বাণী বলে গ্রহণ করবো: সকল উৎপীড়কের বিরুদ্ধে, সকল উৎপীড়িতের সঙ্গে।’

শুধু কবিতা নয়, বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বুদ্ধদেবের স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। তিনি রোম্যান্টিক কবিচেতনার অধিকারী ছিলেন; তবে পরবর্তীকালে তিনি আবেগ অপেক্ষা মননশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মননশীল প্রবন্ধ ও সাহিত্য-সমালোচনায় তিনি সূক্ষ্ম বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গদ্যশৈলীতে আছে ব্যক্তিত্বের ছাপ। পদ্যগদ্য মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: কবিতা বন্দীর বন্দনা (১৯৩০), কঙ্কাবতী (১৯৩৭), দ্রৌপদীর শাড়ী (১৯৪৮), শীতের প্রার্থনা: বসন্তের উত্তর (১৯৫৫), যে অাঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮); উপন্যাস লাল মেঘ (১৯৩৪), রাতভর বৃষ্টি (১৯৬৭), পাতাল থেকে আলাপ (১৯৬৭), গোলাপ কেন কালো (১৯৬৮); গল্পগ্রন্থ অভিনয়, অভিনয় নয় (১৯৩০), রেখাচিত্র (১৯৩১), ভাসো আমার ভেলা (১৯৬৩); নাটক তপস্বী ও তরঙ্গিণী (১৯৬৬), কলকাতার ইলেকট্রা, সত্যসন্ধ (১৯৬৮); প্রবন্ধ কালের পুতুল (১৯৪৬), সাহিত্যচর্চা (১৯৫৪), রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য (১৯৫৫), স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭); ভ্রমণ ও স্মৃতিকথা হঠাৎ আলোর ঝলকানি (১৯৩৫), সব-পেয়েছির দেশে (১৯৪১), জাপানি জার্নাল (১৯৬২), দেশান্তর (১৯৬৬), আমার ছেলেবেলা (১৯৭৩), আমার যৌবন (১৯৭৬); অনুবাদ কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭), শার্ল বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা (১৯৬০), রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা (১৯৭০) ইত্যাদি।

বুদ্ধদেব বসু শিশুদের উপযোগী কয়েকখানি গ্রন্থও রচনা করেন। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করেও তিনি ইউরোপ-আমেরিকায় প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন। তপস্বী ও তরঙ্গিণী নাটকের জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৬৭) লাভ করেন। ১৯৭০ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত করে। এছাড়া স্বাগত বিদায় কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৭৪) লাভ করেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ কলকাতায় মৃত্যু হয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত