জর্জ অরওয়েল

প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০১৮, ১০:৩৮

 

জর্জ অরওয়েল। এই ছদ্মনামের আড়ালে কালোত্তীর্ণ ভুবন বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক লেখকের প্রকৃত নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের মতিহারিতে ১৯০৩ সালে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে তিনি জর্জ অরওয়েল ছদ্মনামে সমধিক পরিচিত। তাঁর দুটি উপন্যাস - 'এনিমেল ফার্ম' ও 'নাইন্টিন এইটি ফোর'- বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থের তালিকায় স্থান পেয়েছে। তিনি আজীবন স্বৈরাচার ও একদলীয় মতবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। রিচার্ড ওয়ামেসলে ব্লেয়ার ও ইদা মাবেল লিমুজিন দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিলেন জর্জ অরওয়েল। তাঁর বাবা ভারতের সিভিল সার্ভিসে চাকরি করতেন। ১৯০৭ সালে সপরিবারে ইংল্যান্ডে চলে যান তারা।

১৯১৭ সালে ইটনে পড়াশোনা করার সময় সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে জর্জ অরওয়েলের। এ সময় বিভিন্ন কলেজ ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় পুলিশ বিভাগের হয়ে বার্মায় কাজ করেন অরওয়েল। চাকরির এই অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রথম উপন্যাস লিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর 'বার্মিজ ডেজ'। পরবর্তীতে ক’টা বছর দারিদ্র্যের কষ্ট পোহাতে হয় অরওয়েলকে। ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে দুটো বছর প্যারিসে কাটান তিনি। এ সময় জীবিকার জন্য বিভিন্ন কাজ করতে হয় তাকে। কখনো গৃহশিক্ষক ছিলেন, কখনো স্কুলে পড়াতেন, কখনো বা বইয়ের দোকানে বই বিক্রি করতেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখিও চালিয়ে গেছেন। বিভিন্ন সাময়িকীতে তখন তার বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয় জর্জ অরওয়েলের ‘ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন’।

১৯৩৬ সালে ভিক্টর গোলাঙ্কজের কাজ নিয়ে তিনি পরিদর্শন করতে যান ল্যাঙ্কাশায়ার এবং ইয়র্কশায়ারের বেকারত্বপূর্ণ এলাকাগুলো। এই অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীতে লেখেন 'দ্য রোড টু উইগান পায়্যার'। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে জর্জের নিজ চোখে দেখা দারিদ্র্যের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে নিখুঁত বর্ণনার মাধ্যমে।

১৯৩৬ সালের শেষ দিকে প্রজাতন্ত্রের সমর্থনে যুদ্ধ করতে অরওয়েল স্পেন চলে যান । যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি আহত হন। গৃহযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন 'হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া' বইটি। ১৯৩৮ সালে তাঁকে শারীরিক অসুস্থতায় পেয়ে বসে। একটি স্যানাটোরিয়ামে কিছুদিন থাকতে হয় তাঁকে। এরপর থেকে কখনো পুরোপুরি সুস্থ হন নি তিনি। মরক্কোতে মাস ছয়েক ছিলেন অরওয়েল। এ সময় লেখেন 'কামিং আপ ফর এয়ার'। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হোম গার্ড এবং বিবিসির ইস্টার্ন সার্ভিসে কাজ করেন তিনি। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ওই কাজেই নিয়োজিত ছিলেন অরওয়েল। পরে সাহিত্যসম্পাদক হিসেবে যোগ দেন 'ট্রিবিউন' পত্রিকায়। এ সময় রাজনীতি এবং সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। একই সঙ্গে অবজারভার’ এবং ‘ম্যানচেস্টার ইভনিং নিউজ’ পত্রিকায়ও লিখেছেন। তাঁর রূপকধৰ্মী চমৎকার রাজনৈতিক উপন্যাস 'অ্যানিমেল ফার্ম' প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে। এখানে তিনি একটি পশুখামারের ভেতর একটি রাজনৈতিক পটভূমি সৃষ্টি করেছেন। এটা মূলত রাশিয়ান রেভুলেশনের স্টেনের বিদ্রোহের উপর ভিত্তি করে লেখা। গ্রন্থটি অরওয়েলের জন্য খ্যাতি নিয়ে আসে।জীবনে প্রথমবারের মত তিনি আর্থিকভাবে সন্তুষ্ট হন।

জর্জ অরওয়েল এর এনিম্যাল ফার্ম উপন্যাসে মানুষের কাছ থেকে পশুপাখিরা ফার্মটি স্বাধীন করে নেয়। যেমন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম পাকিস্তানের কাছ থেকে। এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আসে। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই একটি সংবিধান রচনা করে এনিম্যাল ফার্মের নেতারা। এনিম্যাল ফার্ম উপন্যাসের নেতাগুলো শুয়োর যাদের নাম নেপোলিয়ন, স্নোবল, স্কুয়েলার। স্কুয়েলারের কাজ হচ্ছে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো। সংবিধান রচিত হলে ফার্মের দেয়ালে লেখা হলো ৭ টি কমান্ডমেন্টস। 
১. Whatever goes upon two legs is an enemy.
২. Whatever goes upon four legs, or has wings, is a friend.
৩. No animal shall wear clothes.
৪. No animal shall sleep in a bed.
৫. No animal shall drink alcohol.
৬. No animal shall kill any other animal. 
৭. All animals are equal.
এই তো কতো সুন্দর গণতান্ত্রিক একটি সংবিধান। আর মানুষের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করে বলে ফার্মের একটি স্লোগান ছিলো। “Four legs good, two legs bad”। এনিম্যাল ফার্মে দিন যাচ্ছে। ঘোড়া, বক্সার আর ক্লোভার খুব বেশি পরিশ্রম করে। স্বাধীন দেশ। মুরগীগুলো ডিম পাড়ে। আগের চেয়ে বেশি বেশি পরিশ্রম করছে সবাই শুধু শুয়োরগুলো ছাড়া। সবাই পরিশ্রম বেশি করলেও কিন্তু দুধ আর আপেলগুলো খায় শুয়োরগুলো। অন্যদের খাবারে মানুষের শাসনামলে যা জুটতো তাই। কোন পরিবর্তন নাই। কিন্তু পশুপাখিগুলো মানুষকে চরম ঘৃণা করে। তাই তাদের সংবিধানে মানুষ যা করতো তা নিষিদ্ধ। শুয়োরেরা যে দুধ আর আপেল খায়, কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের দেয় না।

১৯৪৯ সালে 'নাইনটিন এইটি ফোর' গ্রন্থটি লেখা শেষ করেন জর্জ অরওয়েল। ততদিনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে, হিটলারের পতন হয়েছে এবং পৃথিবী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক দুই পরাশক্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তিনি ইতোমধ্যে হিটলারের জার্মানিকে দেখেছেন। সেদেশে একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার উত্থান দেখেছেন। একই সময় দেখেছেন স্তালিন নামক এক চূড়ান্ত একনায়ক ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক আরেক স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বগ্রাসী জয়রথ। এদের সবাইকে ছাপিয়ে মহাসমুদ্রের ওপারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিশ্বের প্রথম উত্তর-পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আজীবন সমাজতন্ত্রী আদর্শে বিশ্বাসী অরওয়েল এই ভেবে উদ্বিগ্ন ছিলেন, রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে অতিক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর লাগামহীন উত্থানের ফলে রাষ্ট্র হয়ে পড়বে নিষ্পেষণের হাতিয়ার, ব্যক্তি হারাবে মতপ্রকাশের যাবতীয় স্বাধীনতা। শুধু তাই নয়, একসময় স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলবে ব্যক্তি। ব্যক্তির প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারির ক্ষমতা থাকবে সরকারের। এর পরও যদি ভিন্নমতের কোনো চেষ্টা হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে যে অফুরন্ত ক্ষমতা রয়েছে, যে-কোনো ব্যক্তি অথবা দলকে পিষে ফেলতে সে-শক্তি ব্যবহারে সে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। স্বৈরতন্ত্রের বিপদ সম্বন্ধে পৃথিবীর মানুষকে সাবধান করে দিতেই লেখা হয়েছিল 'নাইনটিন এইটি ফোর' গ্রন্থটি। গ্রন্থের কাহিনি-বিস্তার হয়েছে লন্ডনের পটভূমিতে। রক্ষণশীল অথবা আধা-উদারনৈতিক লেবার পার্টির নেতৃত্বাধীন ব্রিটেনেও স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অসম্ভব নয়, অরওয়েল এমন ধারণাও পোষণ করতেন। অরওয়েল কেবল সাবধান করেই পার পেয়েছিলেন, ১৯৫০ সালে মৃত্যু হওয়ায় তাঁকে মাওবাদী চীন দেখতে হয়নি, কম্বোডিয়ার খেমাররুজকে দেখতে হয়নি, দেখতে হয়নি পিনোসে, সাদ্দাম ও ইয়াহিয়াকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক লক্ষণ তাঁর কাছে ধরা পড়েছিল, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক বিপদ তাঁকে দেখতে হয়নি। যে-স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তিনি কল্পনার চোখে দেখেছিলেন, আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিণত হওয়ার প্রকৃত আশঙ্কার মুখোমুখি। ঠিক সে-কারণে এ-গ্রন্থ প্রকাশের অর্ধশতক অতিবাহিত হওয়ার পরও অরওয়েলের কল্পকাহিনি ১৯৮৪ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তখন যা ছিল কল্পকাহিনি, এখন তা মোটেই কল্পকাহিনি নয়।

১৯৯৫ সালে এই বইটি ডাব্লিউ. এইচ. স্মিথ এবং পেঙ্গুইন বুকস থেকে 'শতাব্দীর সেরা গ্রন্থ'-এর পুরস্কার অর্জন করে। মূলত ‘অ্যানিমেল ফার্ম এবং ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’ -এই দুটি বইয়ের জন্যই জর্জ অরওয়েল বিশ্বজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। ১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারি মাত্র ৪৬ বছরবয়সে যক্ষ্মারোগে অাক্রান্ত হয়ে লন্ডনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই খ্যাতিমান লেখক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত