কবি এডগার অ্যালান পো

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০১৮, ১০:৩৭

বিশ্বনন্দিত মার্কিন কবি এডগার অ্যালান পো'র ‘দ্য রেভেন’ বা ‘দাঁড়কাক’ কবিতাটি রোম্যান্টিকতা, মোহন সুরেলা ছন্দময়তা ও তার রহস্যময় পরিমণ্ডলের জন্য বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতারূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কবি, ছোট গল্পকার, সম্পাদক, সমালোচক এডগার অ্যালান পো জন্মগ্রহণ করেন ১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রোমান্স আন্দোলনের অন্যতম নেতা। গভীর আবেদনময় কবিতা ও ব্যতিক্রমধর্মী ছোটগল্প রচনা করে শুধু মার্কিন সাহিত্যভুবনে নয়, বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনেও নিজের জন্য একটি গৌরবমণ্ডিত স্থায়ী আসন নির্মাণ করেছেন তিনি। পো'র বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হেলেনের প্রতি’, ‘স্বপ্ন’, ‘ইস্রাফিল’, ‘দাঁড়কাক’, ‘অ্যানাবেল লী’ প্রভৃতি। অ্যালান পো তাঁর বেশ কয়েকটি ছোটগল্পে উল্লেখযোগ্য নৈপুণ্যের সঙ্গে রহস্যময়, ভুতুড়ে, মৃত্যুর গন্ধমাখা, খুনখারাবি ভরা, আতঙ্কতাড়িত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। গোয়েন্দা-গল্পের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।

পো'র বয়স কুড়ি বছর হবার আগেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন এবং তখনই তাঁর কিছু কিছু রচনা প্রকাশিত হয়। আত্মহত্যাপ্রবণ পো নানারকম অসুস্থতায় ভুগতেন। তিনি অনেক রহস্য ও রোমাঞ্চকর গল্প এবং অনেক হরর গল্পও লিখেছেন। তাঁর পূর্বে এমন হরর গল্প আর কেউ খুব একটা লেখেননি। এজন্যে তাঁকে রোমাঞ্চ জাগানো গল্পের জনকও বলা হয়। 

পিতা ডেভিড পো জুনিয়র এবং মা এলিজাবেথ আরনল্ড পো। ১৮০৩ সালে চার্লেস্টন থিয়েটারে নাটকের অভিনয় দিয়ে ডেভিড পো’র পেশাগত জীবনের যাত্রা শুরু। সুদর্শন ডেভিড পো ছিলেন মদ্যপায়ী, অস্থিরচিত্ত খিটখিটে মেজাজের মানুষ। অভিনয় কুশলী হিসেবে সাধারণ। অন্যদিকে মা এলিজাবেথ পো ছিলেন পরিশ্রমী এবং অভিনয়ে মানুষকে অভিভূত করার এক ঐতিহ্য রেখে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তখনও আমেরিকা, বিশেষ করে নিউ ইংল্যান্ডের অভিজাত শ্রেণীর কাছে নাটক ছিল এক অসম্মানজনক পেশা। তবুও বোস্টন থেকে চার্লেস্টন পর্যন্ত এলিজাবেথ নাটকের অভিনয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রথম স্বামী চার্লস হপকিন্স্-এর মৃত্যুর পর তিনি ডেভিড পো জুনিয়রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে পো ছিলেন দ্বিতীয়। পরে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে এবং এলিজাবেথ ১৮১১ সালের ৮ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ফলে রিচমন্ডের সম্ভ্রান্ত পরিবারের দুই মহিলা, মিসেস জন অ্যালেন এবং মিসেস উইলিয়াম মেকেঞ্জি এডগার পো এবং তাঁর বোন রোজালিনকে পোষ্য সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। এলিজাবেথ তাঁর সন্তানদের জন্য সাহস, যথাকর্তব্য এবং মানুষকে ব্যক্তিত্বের প্রকাশে বিমুগ্ধ করার উদাহরণ রেখে গিয়েছিলেন।

নিঃসন্তান মিসেস জন অ্যালেনের প্রতি এডগার পো এক ধরণের আকর্ষণ অনুভব করতেন এবং তিনি সারা জীবন এই অনুভূতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মিঃ জন অ্যালেন ছিলেন একজন সফল স্কটিশ ব্যবসায়ী এবং আমেরিকার রিচমন্ডে সুপ্রতিষ্ঠিত। ভাল পরিবেশেই বেড়ে উঠছিলেন এডগার পো। আইনসঙ্গত ভাবে দত্তক পুত্রের স্বীকৃতি না দিলেও এডগার পো’কে তিনি ভাল স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। তাই এডগার পো’কে ঐ পরিবারের সন্তান হিসেবেই স্বীকার করে নিয়েছিল রিচমন্ডের লোকজন। ব্যবসায়িক কারণে জন অ্যালেন ১৮১৫ সালে ইংল্যান্ড যান। যখন এডগার পো স্কটল্যান্ড ঘুরে দেখার সুযোগ পান। পাঁচ বছর জন অ্যালেন পরিবার নিয়ে ইংল্যান্ডে বসবাস করেন। সে সময় এডগার পো দুটি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। দ্বিতীয়টি ছিল ম্যানর হাইস্কুল যার সভাপতি ছিলেন ড. জন ব্রান্সবি। এখানেই পো পরিচিত হন এডগার অ্যালেন নামে। এখানে তিনি ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ, ইতিহাস এবং সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী সময় তিনি তাঁর উইলিয়াম উইলসন চরিত্রে ব্রান্সবিকে চিত্রায়িত করেন।

অর্থনৈতিক কারণে জন অ্যালেন ১৮২০ সালে রিচমন্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন। এডগার পো’কে স্কুলে পাঠাতে থাকেন জন অ্যালেন। কয়েক বছর পর স্কুলের প্রধান শিক্ষক জোসেফ এইচ কার্ক, এডগার পো সম্বন্ধে এই মন্তব্য করেন যে, তাঁর ছাত্রটি খুব অধ্যবসায়ী না হলেও ক্লাশে তাঁর ফলাফল সন্তোষজনক। তাঁর আত্মসম্মানবোধ প্রখর এবং কল্পনাশক্তি অতি উচ্চমানের। কার্কের স্কুলে পো হোরেস, সিসেরো এবং হোমার অধ্যয়ন করেন। ১৮২৩ সালে উইলিয়াম বার্ক একাডেমিতে প্রবেশ করার পরও তিনি ধ্রুপদী সাহিত্য এবং অংকশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে থাকেন। পিতা মাতা অভিনয়ের সাথে যুক্ত থাকার কারণে রিচমন্ডের স্কুলে অধ্যয়নের সময় অ্যালেন পোকে নানা ধরণের বিড়ম্বনা এবং তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হতো। তবে একজন ভাল সাঁতারু হওয়ার কারণে তিনি প্রশংসাও অর্জন করেছিলেন। স্কুলের একজন সহপাঠি রবার্ট স্ট্যানার্ড-এর মাধ্যমে এডগার পো সম্ভ্রান্ত এক মহিলা মিসেস জেইন ক্রেইগ স্ট্যানান্ডর্-এর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। এই মহিলার সহানুভূতিশীল ব্যবহারই ছিল অ্যালেন পোর কবিতার প্রথম আবেগের প্রকাশ, যার জন্য তিনি ‘হেলেন-এর জন্যে’ শিরোনামে একটি অনবদ্য গীতি কবিতা রচনা করেন।

জন অ্যালেন ক্রমশ এডগার পো’র জন্য সহানুভূতি হারাতে থাকেন। সারা এলমিরা রয়স্টারের সাথে বাল্য প্রেমের মতো একটি সাধারণ ব্যাপারে অ্যালান পো জড়িয়ে পড়লে জন অ্যালেন তাঁদের এই প্রেমের সম্পর্কে বাঁধা প্রদান করেন। এ ব্যাপারে এলমিরার পিতাও সহযোগিতা করেন। রিচমন্ড থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য জন অ্যালেন শার্লসভিলে, ভার্জিনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এডগার পোকে পাঠিয়ে দেন।

একটি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে থমাস জেফারসন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষাদান এবং শৃঙ্খলা গতানুগতিক হলেও এই ইনষ্টিটিউটের প্রাচীন এবং আধুনিক ভাষা শিক্ষার মান ছিল অতি উচ্চস্তরের। ১৮২৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য অ্যালেন পো উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে পোর সামগ্রিক খরচ বহনের জন্য অ্যালেন অপরাগতা প্রকাশ করলে অ্যালেন পো অর্থ সংগ্রহের জন্য জুয়া খেলে ২০০০ ডলার হেরে বসেন। জন অ্যালেন এই অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ঐ বছরই অ্যালেন পো’র নিয়মিত শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে। তবে তিনি অনার্স নিয়ে ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ অধ্যয়ন করেন এবং ইটালিয়ান এবং স্প্যানিশ ভাষাও অধ্যয়ন করেন। তিনি মার্শালের লেখা ওয়াশিংটনের জীবনসহ ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণা লাভে সচেষ্ট হন। অতি মাত্রায় মদ্যপান এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে তাঁর উচ্ছৃঙ্খলতা বা অশোভন আচরণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় এক বছর তিনি অধ্যয়ন করেন। তবে অর্থাভাবে তা ছেড়েও দেন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে আছে নানা রহস্য। সংবাদপত্রে তখন বলা হয়েছিল, মস্তিষ্কের মারাত্মক রোগে অ্যালান পো মারা গেছেন। তিনি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ ও রবীন্দ্রনাথের প্রিয় কবি। দীর্ঘ এক দশক ধরে রিচমন্ড, ফিলাডেলফিয়া ও নিউ ইয়র্কে ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন তিনি। এডগার অ্যালেন পো কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, একজন বড় লেখক হতে হলে কী লাগে? তিনি জবাব দিলেন, একটা বড় ডাস্টবিন লাগে। লেখা নামক যেসব আবর্জনা তৈরি হবে তা ফেলে দেয়ার জন্য। লেখকরা ক্রমাগত আবর্জনা তৈরি করেন। নিজেরা তা বুঝতে পারেন না।

মৃত্যুর আগে পো একা একা বাস করতেন নিউইয়র্কের কাছাকাছি ছোট্ট এক কুটিরে। অনেকেই মনে করেন, সেসময় তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিষণ্ন এবং সাধারণ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এক আলাদা মানুষ। ১৮৪৯ সালের ৩ অক্টোবর হঠাৎ তাঁকে পড়ে থাকতে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের রাস্তায়। জোসেফ ওয়ালকার নামের এক সহৃদয় ব্যক্তি তাঁকে ওয়াশিংটন কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তাররা তাঁকে বাঁচাতে পারেন নি, অনন্তের পথেই যাত্রা করেন তিনি। ঠিক কী কারণে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তার কারণ আজও জানা যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন, মৃত্যুর আগে অ্যালকোহলে আসক্ত ছিলেন তিনি। যার কারণে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।

১৮৩৩ সালে অ্যালেন পো Baltimore Sunday Visitor পত্রিকার ছোট গল্প প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে ৫০ ডলার পুরস্কার লাভ করেন। গল্পটির নাম ছিল The Manuscript Founded in a Bottle। জীবনানন্দ দাশের অতি বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর উৎস এডগার অ্যালেন পো’র কবিতা ‘টু হেলেন’। পো’র ‘হেলেন’ থেকে হয়েছে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’। রবীন্দ্রনাথের ‘একই গাঁয়ে’ আর এডগার অ্যালেন পো’র ‘অ্যানাবেল লি’ একই কবিতা। পার্থক্য বলতে অ্যালেন পো লিখেছিলেন ইংরেজিতে আর কবি গুরু লিখেছিলেন বাংলায়।

১৮৩৫ সালে জ্ঞাতি বোন ভার্জিনিয়া ক্লেমকে বিয়ে করেন এডগার অ্যালেন পো। ১৮২৭ সালে তিনি বোস্টনে পালিয়ে যান। এখানে পো ছিলেন নিজের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। জন অ্যালেন-এর সাথে সম্পর্কের বিচ্যুতির কারণে বেদনাবিদ্ধ ছিল তাঁর মন। বোস্টনে তিনি একজন অতি অপরিচিত মুদ্রকের সাহায্যে তাঁর প্রথম কবিতার বই Tamarlane and Other Poems প্রকাশ করেন। লেখক হিসেবে নিজের নাম উল্লেখ না করে লেখেন by a Bohemian। এতে তাঁর অর্থ উপার্জন হয়নি, কোনো প্রশংসাও তিনি অর্জন করেননি। অথচ প্রথম সংস্করণের এই কাব্যগ্রন্থটির এক কপির মূল্য ১৯৯২ সালে ধার্য হয়েছিল ১৫০০০ ডলার। এই বইটির প্রথম সংস্করণ এতই দুষ্প্রাপ্য যে এর একটি কপি দুই লক্ষ ডলারে বিক্রয় হয়েছে।

এডগার অ্যালেন পো তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনায় কখনোই দুই বছরকাল সামরিক বাহিনীতে কাজ করার কোনো বর্ণনা দেননি। সম্ভবত আত্মসম্মান হানিকর মনে করেই তিনি সামরিক বাহিনীতে কাজ করার কথা উল্লেখ করেন নি। তিনি এই সময়ে ইউরোপ ভ্রমণের এক কল্পকাহিনী রচনা করেন। সামরিক বাহিনীতে তিনি প্রশংসনীয় কাজের জন্য সার্জেন্ট মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। জন অ্যালেন এক পর্যায়ে পো’কে সামরিক বাহিনী থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন। ১৮২৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারী মিসেস জন অ্যালেন মৃত্যুবরণ করেন। শেষ পর্যন্ত অ্যালেন পো তাঁকে আর জীবিত অবস্থায় দেখার সুযোগ করতে পারেন নি, যদিও তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তিনি উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত