মতি নন্দী

প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১১:৪৬

নিজের দেখা সমাজের ভেতর থেকে সযত্নে গল্পের উপাদান কুড়িয়েছেন মতি নন্দী৷ তাঁর অনেক লেখাতেই মৃত্যু এসেছে প্রবল ভাবে৷ নিজেই তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, "আমার লেখায় গত ছ 'সাত বছর ধরে মৃত্যু প্রবেশ করেছে৷ 'পিকনিকের অপমৃত্যু', 'একটি মহাদেশের জন্য', 'শবাগার' অনেক গল্পেই মৃত্যু ছায়া ফেলেছে৷ হয়তো চারপাশের বীভৎস খুন এবং প্রগাঢ় নপুংসকতা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছি, কিম্বা ছেচল্লিশে দেখা সাম্প্রদায়িক দলবদ্ধ হত্যা দর্শনের স্মৃতির দ্বারা৷" তাঁর রচনা এখনও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলতেন, "এখন বন্যার মতো স্বপ্নরাজি ঢেলে দিচ্ছে এ দেশের গণমাধ্যম৷ এই ফ্যান্টাসিকে বলা হচ্ছে গণসংস্কৃতি৷ আমাদের বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতি একে গ্রহণ করতে নারাজ"।

মতি নন্দী বিশ্বাস করতেন, তৃতীয় বিশ্বের নিরক্ষর দরিদ্র দেশের জনসাধারণের কাছে লেখকদের দায়বদ্ধ থাকার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তাঁর প্রায় সব লেখাতেই ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন, প্রেম, যৌনতার পাশাপাশি সমাজ, অর্থনীতি বিবিধ বিষয়ের জটিলতাও স্থান পেয়েছে৷ অসংখ্য আপাত তুচ্ছ বিষয়ের অবতারনার মধ্যে দিয়ে মতি নন্দী সমাজের অন্তর্নিহিত কঠিন সমস্যার কথাগুলো তুলে ধরেছেন। বিষয়গুলো ভেবে দেখলে আজও বিস্ময়ের উদ্রেক হয়। তাঁর জীবনবোধ ও সমাজের প্রান্তে বাস করা মানুষদের প্রতি অসম্ভব দরদ ভালোবাসা ও মমত্ব দিয়ে তিনি লিখে গেছেন৷ কখনোই কোনও তথাকথিত লেখক শিবিরে তাঁর স্থান হয়নি৷ প্রগতি শিবিরের দীর্ঘ তালিকায়ও মতি নন্দীর জায়গা নেই৷ জাতীয়তাবাদী লেখকদের মধ্যেও মতি নন্দীকে নিয়ে তেমন কোনও উচ্ছ্বাস চোখে পড়ে না৷ সামাজিক দায়বোধ থাকা সত্ত্বেও লেখায় যৌন শব্দ ও যৌনতার আধিক্য থাকার জন্যেই সম্ভবত, মার্কসিয় গোষ্ঠী তাঁকে সোচ্চারে নিজেদের লোক বলার সাহস পায়নি, আর যিনি আজীবন প্রগতিবাদে বিশ্বাস করতেন তাঁকে অন্যেরাও স্বীকৃতি দিতে কোনও দিনই চাননি৷ অবশ্য আগেই বলেছি ব্যক্তি মতি নন্দী কোনও দিনই এ সব নিন্দেমন্দ, গোষ্ঠী উপগোষ্ঠী কোনও কিছুরই ধার ধারতেন না৷ তাঁর যাবতীয় দায়বোধ ছিল নিজের কলম ও সমাজের প্রতি৷

মতি নন্দীর লেখায় অধিকাংশ সময়ই উত্তরণের কথা উঠে এসেছে৷ সম্ভবত উনি বিশ্বাস করতেন চেষ্টা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা থাকলে মানুষ যন্ত্রণার মধ্যেও জিততে পারে৷ কোনি-র শিক্ষক ক্ষিতীশ সিংহের মুখ দিয়ে মতি নন্দী বলিয়েছেন, "মানুষ পারে, সব পারে৷" মতি নন্দীর চরিত্রগুলো উঠে এসেছে কোনও কল্পলোকের রাজ্য থেকে নয়, মাটির পৃথিবী থেকে৷ ক্ষিতীশ সিংহের ছায়া সাঁতারের কোচ কে পি সরকার৷ আরও অজস্র চরিত্র যাদের কথা বলতে গিয়ে মতি নন্দী অক্লান্ত থাকতেন৷ সেই কাবাডির ইনসান আলি, সাঁতারের বেণীমাধব তালুকদার এ রকম অজস্র মানবের লড়াই তাঁকে প্রাণিত করেছে৷

ভারতের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া 'কোনি' চলচ্চিত্রের সেই বিখ্যাত সংলাপ- "ফাইট কোনি, ফাইট"। সমাজের এক কোণে পড়ে থাকা কিশোরী সাঁতারুকে এ কথাটি বলেই জেতার স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিলেন তার প্রশিক্ষক। পশ্চিমবাংলার ক্রীড়াবিদ আর কোচদের কাছে চিরকালের প্রেরণা হয়ে থাকবে কোনির এই সংলাপ। এই বিখ্যাত সংলাপের লেখক বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক মতি নন্দী। যদিও শুধু ক্রীড়া সাংবাদিক কথাটা মোটেও যথেষ্ট নয় মতি নন্দীর জন্য। 

১৯৩১ সালের ১০ জুলাই উত্তর কলকাতায় জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি সাংবাদিক সাহিত্যেও এনেছিলেন এক অন্য স্বাদ। আনন্দ পুরষ্কার পাওয়া এই ঔপন্যাসিক তাঁর ধারালো গদ্যে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। লস অ্যাঞ্জেলেস ও মস্কো অলিম্পিক, দিল্লি এশিয়ান গেমস কভার করা এই সাংবাদিক দীর্ঘদিন ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদক। তাঁর কোনি, স্টপার, স্ট্রাইকার- এর মতো উপন্যাসগুলো এক দিকে যেমন খুলে দিয়েছে বাংলা ক্রীড়া সাহিত্যের নতুন দরজা তেমনি সাদা খাম, গোলাপ বাগান, উভয়ত সম্পূর্ণ, আর বিজলীবালার মুক্তি-র মতো উপন্যাসগুলোও ঠাই পাবে বাংলা ধ্রুপদী সাহিত্যে। পাঠকদের একেবারে ভিন্ন লেখার স্বাদ দিয়েছে তাঁর অবিনাশের সাড়ে আটচল্লিশ, কপিল নাঁচছে, রেড্ডি, আর অন্ধকার থেকে অন্ধকার ছোটগল্পগুলোও। ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত