রুডইয়ার্ড কিপলিং

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:০২

ইংরেজ কবি ও ছোটগল্পকার রুডইয়ার্ড কিপলিং যে দৈনিক পত্রিকাটি রাখতেন সে পত্রিকায় একদিন ভুলবশত তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়ে যায়। সংবাদটি দেখে তিনি ভীষণ রেগে যান। সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদককে লিখলেন, ‘এইমাত্র আপনার পত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম যে আমি মারা গেছি। আপনার গ্রাহক তালিকা থেকে আমার নামটি দয়া করে বাদ দেবেন’।

১৮৯৪ সালে ভারতের জঙ্গল-পাহাড়ের রূপকথা গ্রন্থিত করেছিলেন রুডইয়ার্ড কিপলিং। 'জাংগল বুক' ভিত্তি করে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তির পরে কেটে গিয়েছে আরও ৫০ বছর। জঙ্গলের জাদু আজও অক্ষুণ্ণ। মোগলি-বাঘিরা-বালু-কা-শের খানেরা এভাবেই জীবন্ত চরিত্র হয়ে আছে সবার মনে। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না 'মোগলি' নামটাই ভুল। লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং স্বয়ং জানিয়েছিলেন, তিনি ‘মাউগলি’কে সৃষ্টি করেছিলেন, শব্দটির অর্থ ব্যাঙ ! ১৯৬৭ সালে ওয়াল্ট ডিজনির সৌজন্যে ‘মাউগলি’ হয়ে যায় 'মোগলি'। তারপর থেকে সারা পৃথিবী সেই নামই জানে। কিপলিংয়ের মেয়ে এলসি ব্যামব্রিজ নাকি এ ঘটনার জন্য কোনওদিন ক্ষমা করেননি ডিজনিকে।

শব্দের জাদুকর কথা সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং বলতেন, "শব্দই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা মানুষ দ্বারা ব্যবহত হয়।" কিপলিং জন্মেছিলেন বৃটিশ ভারতের বোম্বে (মুম্বাই) শহরে। ১৮৬৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি জন লকউড কিপলিং এবং অ্যালিস কিপলিং দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহন করেন । তাঁর পিতা একজন ভাস্কর ছিলেন। তাঁর পিতা- মাতা নিজেদের এ্যাংলো ইন্ডিয়ান বলে দাবী করতেন যার ফলে তিনি শৈশবে কিছুটা অস্তিত্ব সংকটে ভুগতেন যার ছাপ পরে আমরা তাঁর লেখায় দেখতে পাই।

নোবেলজয়ী এই সাহিত্যিকের পুরো নাম যোসেফ রুডইয়ার্ড কিপলিং। বিশ্ব সাহিত্যে তিনি রুডইয়ার্ড কিপলিং নামেই পরিচিত। তাঁর শিক্ষাজীবন কেটেছে ইংল্যান্ডে কিন্তু ১৮৮২ সালে নাড়ির টানে আবার ফিরে এসেছিলেন ভারতে। এ বছরই বিয়ে করেন ক্যারোলিন ব্যালিস্টিয়ারকে। এরপর তারা ভারমন্ট-এ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। এই ভারমন্টে বসেই তিনি রচনা করেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য জাঙ্গল বুক’। সেটা ছিল ১৮৯৪ সাল। ‘গুঙ্গা দিন’ও এখানেই থাকাকালীন লিখে ফেলেন। যেটা তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া লেখকে পরিণত করে।

কিপলিং-এর জন্মের কিছুকাল আগে তাঁর শিল্পী বাবা এবং মা অন্য অনেক ব্রিটিশের মতো ভাগ্য অন্বেষণে ভারতের মাটিতে পা রাখেন। কিপলিংয়ের কাছে ভারত ছিল এক বিস্ময়। এখানকার মানুষ এবং তাদের সহজ সরলতা মুগ্ধ করত শিশু কিপলিংকে। কিপলিং তাঁর ছোট বোন এলিসকে নিয়ে স্থানীয় বাজারে গৃহপরিচারিকার সাথে ঘুরতে যেতেন প্রায়শই। তিনি স্থানীয় ভাষা শিখে ফেলেন এবং এখানকার মানুষকে ভালবাসতে শুরু করেন। কিন্তু মাত্র ৬ বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ডের সাউথ সিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। তিনি ফস্টার পরিবারে জায়গা পান, কিন্তু কিপলিং বাজে অভিজ্ঞ। সংসারের কর্ত্রী মিসেস হলোওয়ে ছিলেন একজন নির্দয় মহিলা। তিনি প্রায়শই ছোট্ট কিপলিংকে অত্যাচার করতেন। যে কিনা তখন স্কুলের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।

তবে কিপলিং ছোটবেলা থেকেই গল্পের বইয়ে শান্তি খুঁজতেন। তাঁর খুব অল্পই বন্ধু ছিল। ড্যানিয়েল ডিফো, র‌্যালফ ওয়ালডো এমারসন, উইলকি কলিনস প্রমুখের বইয়ের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। কিপলিংয়ের বয়স যখন ১১, তখন নার্ভাস ব্রেকডাউনের দ্বারপ্রান্তে। সৌভাগ্যক্রমে এক আত্মীয় তাকে দেখে অনতিবিলম্বে কিপলিংয়ের মাকে জানায়। তাঁর মা ইংল্যান্ডে ফিরে এসে মিসেস হলোওয়ের কাছ থেকে সরিয়ে তাকে রাহুমুক্ত করে। তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় ডেভনের একটি স্কুলে। এটি ছিল তাঁর জীবনের যুগান্তকারী ঘটনা। এখানেই কিপলিং লেখার জন্য তাঁর মনোযোগকে একীভূত করেন। মজার তথ্য হচ্ছে এই বয়সেই তাকে স্কুলের ম্যাগাজিনের সম্পাদক বানানো হয়।

১৮৮২ সাল। রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের পরিবার তাঁকে জানিয়ে দিল যে তাদের পক্ষে আর পড়াশোনার খরচ যোগানো সম্ভব নয়। তাঁকে অবিলম্বে ভারতে ফিরে যেতে বলা হয়। পরিবারের সাথে লাহোরে বাস করতে শুরু করেন তিনি। বাবার সহায়তায় একটি সংবাদপত্রের অফিসে কাজ নিতে সক্ষম হন। অফিসের কাজ শেষ করে শহরের অলিতে গলিতে ঢুঁ মারতেন তিনি। কখনো আফিমের আড্ডায় কখনো বা আবার পতিতালয়ে। এই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ৪০টি ছোটগল্পের সমন্বয়ে 'প্লেইন টেলস ফ্রম দি হিলস' নামে একটি বই লিখেছিলেন। বইটি ইংল্যান্ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

এরই মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়ে যায়। ১৯১৫ সালে তিনি ফ্রান্সে ভ্রমণ করেন যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য। নিজের ছেলে জনকে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করেন। নিজের ছেলেকে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্পে পাঠান তিনি। কিন্তু চোখের দৃষ্টি স্বল্পতার কারণে ব্যর্থ হয় জন। কিন্তু অবশেষে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি জনকে আইরিশ গার্ডে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে ভর্তি করাতে সক্ষম হন। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না কিপলিংয়ের। ১৯১৫ সালের অক্টোবরের দিকে খবর আসে যে ছেলে জনকে ফ্রান্সে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবসাদগ্রস্ত এবং হতাশ হয়ে পড়েন কিপলিং। নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করেন। কারণ তিনিই জনকে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিয়েছিলেন। ছেলেকে খুঁজে বের করতে ফ্রান্স যাত্রা করেন কিপলিং। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে একমাস পরে তিনি ইংল্যান্ড ফিরে আসেন।

একটু ফিরে দেখা যাক, ১৮৮৯ সালের এক দুপুরে লন্ডনের রাস্তায় এক আগন্তুকের সাথে পরিচয় হয় কিপলিংয়ের। ওয়ালকট ব্যালেস্টিয়ার নামে একজন আমেরিকান এজেন্ট, যিনি একজন প্রকাশকও ছিলেন। খুব দ্রুতই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারা দুজনে একসাথে আমেরিকাতে ভ্রমণ করেন। সেখানে ব্যালেস্টিয়ার অন্য নামী লেখকদের সাথে কিপলিংয়ের পরিচয় করিয়ে দেন। ব্যালেস্টিয়ারের সাথে পরিচয় কিপলিংয়ের জীবন আমূল বদলে দেয়। তিনি প্রকাশ করেন তার ছোট গল্পের বই ‘উই উইলি উইনকি’ (১৮৮৮) এবং ‘আমেরিকান নোটস’ (১৮৯১)। ১৮৯২ সালটা ছিল কিপলিংয়ের জন্য বিশেষ একটি বছর। এই বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য, নাম ছিল 'বারাক-রুম ব্যালাডস'। ব্যালেস্টিয়ার এর বোন চেরীর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কিপলিংয়ের। এরই মধ্যে ভারতে বেড়াতে যান কিপলিং। সেখানেই হঠাৎ চেরীর তারবার্তা পান। টাইফয়েডে ভুগে হঠাৎ করেই মারা গিয়েছে ব্যালেস্টিয়ার। চেরী এই সময়ে তার পাশে থাকার অনুরোধ জানায়। ছুটে যান কিপলিং। মাত্র আট দিনের মাথায় তারা এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দু’জন দু‘জনকে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে নিয়ে সারা পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘুরেছেন কিপলিং, মূলত এটিই ছিল তার লেখার রসদ।

১৮৯২ সালে তিনি রচনা করেন 'দ্য নওলাখা : এ স্টোরি অব দ্য ওয়েস্ট এন্ড ইস্ট'। মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি হয়ে ওঠেন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া লেখক। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় 'পাক অব রকস হিল'। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘এ্যাকশন এন্ড রিএ্যাকশন’। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘ডেবটস এন্ড ক্রেডিটস’। ১৯৩২ সালে বাজারে আসে ‘লিমিটস এন্ড রিনিউয়াল’।

তবে জীবনের শেষ সময়টা একদম ভালো কাটেনি কিপলিংয়ের। মারাত্মক আলসারের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। ১৮ জানুয়ারি, ১৯৩৬ সালের এক পড়ন্ত বিকেলে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই অসামান্য শব্দের জাদুকর। ওয়েস্টমিস্টার এ্যাবের কবরস্থানে কবিদের সমাধি ক্ষেত্রে তাঁকে সমাহিত করা হয়। যেখানে তাঁর পাশে রয়েছেন টমাস হার্ডি আর চার্লস ডিকেন্স। রুডইয়ার্ড কিপলিং বিভিন্ন সম্মান জনক ডিগ্রি আর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯০৭ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান। এছাড়া ১৯২৬ সালে তিনি Royal Society of Literature থেকে তিনি স্বর্ণ পদক লাভ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত