সুব্রত মিত্র

প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৪৯

একটি সাদা-কালো বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিংয়ে চায়ের লিকারের রং যথাযথ পাওয়ার জন্য সুব্রত মিত্র অকাতরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। সে সময় উন্নাসিকেরা দূর থেকে হয়তো ভেবেছে- ভদ্রলোকের মাথায় সমস্যা আছে। নিখুঁত হওয়ার জন্য সুব্রত মিত্রের অনুশীলনকে হয়তো বাড়াবাড়ি রকমের বাতিক বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল অনেকের কাছে। তাইতো তিনি পথের পাঁচালী বা চারুলতার মতো অসামান্য ছায়াছবির সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন। তাঁকে বুঝতে একটু সময় লাগবে- সেটাই স্বাভাবিক । সাহেবদের হাত ধরে এদেশে যন্ত্র এসেছিল বলেই হয়তো যন্ত্র প্রসঙ্গে আমাদের সীমাহীন উদাসীনতা। হয়তো সুব্রত মিত্র কিছুটা যন্ত্রপাগল ছিলেন সত্যি। তবে আমরাতো প্রত্যক্ষ করেছি আমৃত্যু তাঁর সিনেমাটোগ্রাফির পাগলামির কারুশিল্প, তাইতো প্রয়াত সুব্রত মিত্র প্রকৃতই অযান্ত্রিক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি কিংবদন্তির বেশি কিছু। শুধু তাই নয়, আমাদের ধুলোমাটিতে একটি মিচেল বা অরিফ্লেক্স ক্যামেরার সৌজন্যে আন্তর্জাতিকতার আকাশেও তিনি এক ধ্রুব নক্ষত্র। সুব্রত মিত্র ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান ক্যামেরাশিল্পী বা চিত্রগ্রাহক। অপু ত্রয়ীসহ সত্যজিৎ রায়ের বেশ কিছু চলচ্চিত্রে কাজের কারণে তিনি খ্যাতিলাভ করেন।

সুব্রত মিত্র একটি বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে ১২ অক্টোবর ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই তিনি সহপাঠীদের সাথে কাছাকাছি সিনেমা হলে ব্রিটিশ এবং হলিউডের চলচ্চিত্র দেখতেন । কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ঠিক করেন তিনি একজন আর্কিটেক্ট নয়তো একজন চিত্রগ্রাহক হবেন । তিনি ক্যামেরা সহকারীর কোন কাজ না পেয়ে বিজ্ঞানে ডিগ্রীর জন্য পড়াশোনা করতে থাকেন । ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক হিসাবে তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা হয় ।

সুব্রত মিত্রের নিজের ভাষ্যমতে, গ্রেট এক্সপেকটেশনস (১৯৪৬) ও অলিভার টুইস্ট (১৯৪৮)– চার্লস ডিকেন্সের এই কাহিনী দুটি তাঁকে খুব আকর্ষণ করেছিল। কাহিনী দুটির চিত্ররূপ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পরিচালক ডেভিড লিন। তিনি দেখলেন উপন্যাসের আখ্যান চলচ্চিত্রে বদলে যাচ্ছে। কাহিনীর চাইতেও তাঁর কাছে আরও বেশি আকর্ষণীয় মনে হলো গাই গ্রিনের অল্প আলোর লাইটিং। পরের বছর দেখলেন পরিচালক ক্যারল রিডের দি থার্ড ম্যান (১৯৪৯)। এখানেও সুব্রত মিত্রের মনে বেশি রেখাপাত করলো রবার্ট ক্রাসকারের সিনেমাটোগ্রাফি। এরপর ১৯৪৭ সালে 'মঁসিয়ো ভিনসেন্ট' চলচ্চিত্র দেখার সময় বুঁদ হয়ে গেলেন ক্লোদ রনোয়ার অস্বাভাবিক ক্যামেরা নৈপুণ্যে। স্বপ্নে-জাগরণে ক্যামেরা তাকে হাতছানি দিতে শুরু করল। আর বলতে গেলে একদম কাকতালীয় ভাবেই একটি অঘটন ঘটে গেল কিছুদিন পরেই। স্বয়ং ক্লোদ রনোয়ার সঙ্গে তরুণ সুব্রত মিত্রের দেখা হয়ে গেল খোদ কলকাতার রৌদ্রালোকিত রাজপথে। আসলে সিনেমার ইতিহাসে যিনি দেবতার মর্যাদা পান, ফরাসি দেশের অবিনশ্বর চলচ্চিত্রস্রষ্টা জঁ রনোয়া 'দ্য রিভার' ছবির শুটিং করতে কলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন চিত্রগ্রাহক ভাইপো ক্লোদ রনোয়া। প্রথমে সুব্রত নিজেই চেষ্টা করে বিফল হন, অবশেষে তাঁর বাবার সর্নিবন্ধ অনুরোধে জঁ রনোয়া নেহাতই দরাপরবশ হয়ে সুব্রতকে ‘অবজার্ভার’ হিসেবে থাকার অনুমতি দিলেন। সুব্রত তখন ক্লান্তিহীন, ছবি এঁকে এঁকে আলোর ব্যবহার, অভিনেতাদের চলাচল, ক্যামেরার অবস্থান সম্পর্কে অবিরত নোট নিতে থাকলেন। একদিন তাঁর ডাক পড়ল ভিতর সভার মাঝে। স্বয়ং জঁ রনোয়া মুগ্ধ হয়েছেন তার পর্যবেক্ষণে। এরপর ক্লোদ রনোয়া লাইট কনটিউনিটির জন্য সুব্রত মিত্রের এই খাতার শরণাপন্ন হলেন। এই ছবি বস্তুত ভারতীয় চলচ্চিত্রে আধুনিকতার আঁতুড়ঘর। এখানেই সুব্রতর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তের– যিনি সেটের কাজ করেছিলেন। আর এখানেই রবিবার, সাপ্তাহান্তিক ছুটির দিনে, শুটিং দেখতে আসতেন তরুণ চলচ্চিত্র শিক্ষার্থী সত্যজিৎ রায়। সুব্রত আগন্তুককে অক্লান্তভাবে বুঝিয়ে যেতেন বাস্তবের অনুপুঙ্খ। অবশেষে সত্যজিৎ মেনে নিলেন– ‘আপনার দেখার চোখ এখন সম্পূর্ণ’। আর তাই মাত্র একুশ বছর বয়সে, কোনওরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই অথবা, শুধু স্থিরচিত্রের অভিজ্ঞতা নিয়েই, সুব্রত মিত্র দায়িত্ব নিলেন সেই ছবির চিত্রগ্রহণের - যা বিশ্বচলচ্চিত্রের একটি মাইলষ্টোন বলে আজও খ্যাত। ভূমিষ্ঠ হলো 'পথের পাঁচালী'। 'পথের পাঁচালী' চলচ্চিত্রে কাজ করার আগে চলচ্চিত্র ক্যামেরার ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না। 'দ্য রিভার' ছবিতে পর্যবেক্ষক হিসাবে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি পথের পাঁচালীর চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । পথের পাঁচালী থেকে 'নায়ক'- সত্যজিৎ রায়ের এই দশটি ছবি ছাড়াও তিনি অন্য পরিচালকের বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দি ছবিতে কাজ করেছেন ।

১৯৯২ সালে ইস্টম্যান কোডাক তাঁকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার দিতে হাওয়াই দীপপুঞ্জে আমন্ত্রণ জানায়। আলমানদ্রোস বা স্তোরারোর মতো দিকপাল সিনেমাটোগ্রাফার পশ্চিমা গোলার্ধ্ব থেকে তাঁকে ‘শ্রীচরণেষু’ বলে সম্বোধন শুরু করতেন। আলমান্দ্রোস একবার বলেছিলেন, ক্যামেরাম্যানই প্রথম দর্শক। অর্থাৎ দৃশ্যের কৌমার্যমোচন ক্যামেরারই কাজ। সুব্রত মিত্র ‘লুক থ্রু’র সময় আসলে যা খেয়াল করতেন, তা হচ্ছে চোখের অভ্যুত্থানের ক্ষমতা। এই ক্ষমতাকে বরেণ্য ফরাসি চলচ্চিত্রকার রবের ব্রেঁস বলেছেন, ‘ইজ্যাকুলেটরি কোর্স অব দ্য আই’। সুব্রত মিত্র ছিলেন অসাধারণ নৈপুণ্যের পক্ষপাতী, কারণ তিনি জানতেন তিনিই দর্শককে চক্ষুদান করবেন। প্রথম প্রেমিক তিনি– তাকে ছাড়া দর্শক সৌন্দর্যের আধ্যাত্মিক মাত্রা বুঝতে পারবে না।

পথের পাঁচালীর সেইসব আউটডোর মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যায় বালিকা দুর্গা যখন কচুপাতায় মুখ লাগায়, তখন সূর্যরশ্মিও কী রকম তরুণ হয়ে ওঠে। সুব্রত হয়তো জঁ রনোয়ার পাঠশালাতেই এসব শিক্ষা লাভ করেছেন তবু এ রকম ইমপ্রেশনিস্ট সিনেমাটোগ্রাফি ভারতবর্ষে এর আগে সম্ভবত হয় নি। একদিকে এদুয়ার মানে-এর মতো ইমপ্রেশনিজমের প্রাথমিক শর্ত– প্রকৃতিতে রেখা নেই, সেই মেঘলা আলো আর বিস্তৃত ধানক্ষেতে অপু, অন্যদিকে কাশবনে সাদা-কালোর ঐতিহাসিক জ্যামিতি, সামান্য দুটি সরকারি আর্কল্যাম্পের সাহায্যে অসুস্থ দুর্গার ঘর থেকে চিনিবাসের চিত্রগ্রহণ অন্ধকার ও আলোয় একটি প্রায় অলীক সেতুবন্ধন। আবার অবাক বিস্ময়ে 'অপরাজিত' চলচ্চিত্রে সুব্রত মিত্রের সিনেমাটোগ্রাফিতে দেখতে পাই একটি জীর্ণ অরিফ্রেক্স ক্যামেরার বদৌলতে বাউন্সড ডিফিউডজ লাইটের প্রাচ্যরীতির আবিষ্কার।

হরিহরের অন্তঃপুর দৃশ্যটির সময় অনিবার্য কারণে বংশী চন্দ্রগুপ্তকে সর্বজয়ার উঠোন সেটে বানাতে হলো আর ইতিহাসের অলৌকিক চক্রান্তে সুব্রত মিত্র সাদা কাপড় থেকে আলো প্রতিফলিত করে উদ্ভাবন করলেন পেলব, বারাণসীর প্রায়ান্ধকার বাড়িতে যে কোমল আলো থাকে– সেই আলো। এই আলোর তারতম্য বলে দিলো, কাশীর উষা কতটা আলাদা প্রদোষের হয়। চারুলতার জন্য সুব্রতকে কিন্তু অন্য কৌশল নিতে হলো। যেহেতু সত্যজিৎ স্থানের গুরুত্ব ও মাত্রা বাড়াতে চাইছিলেন, সুতরাং সুব্রত কাঠের বাক্সের সাহায্যে বাউন্স লাইটিং-এর ছলনা নির্মাণ করে দিলেন। আর কাঞ্চনজঙ্ঘাতে তো রং অজানা অধ্যায় রচনা করে দিলো। কুয়াশার মধ্যে রঙের যে অস্বচ্ছতা– যেন বৃষ্টি ভেজা গাড়ির জানলা দিয়ে দেখা রঙিন পৃথিবী– এ তো সাদা-কালো আর রঙের অন্তর্বর্তী স্তর– রঙিন ফটোগ্রাফিক এমন আশ্চর্য রূপসী পাহাড়কে কে কবে দেখেছে দুনিয়ার বায়োস্কোপে? সুব্রত মিত্র নব্যবাস্তববাদী ব্যাকরণ অনুযায়ী সাধারণত একটি বিশ্বাসযোগ্য আলোর উৎস ফ্রেমে রাখেন, পছন্দ করেন না তীব্র কনট্রাস্ট। কিন্তু ইন্দির ঠাকরুন যখন বালক অপুকে রূপকথার গল্প শোনান, তার মিচেল ক্যামেরা অভাবনীয়রূপে রচনা করে দেওয়ালে ছমছম করা ছায়ামূর্তি– ব্রেমবান্ট এফেক্ট।

'শেক্সপিয়ার ওয়ালা' চলচ্চিত্রে তাঁর ডোর যেন মনোক্রমের আনন্দভৈরবী। পাহাড়ের বৃষ্টির ইন্দ্রিয় শিহরণ চুম্বন করে তাঁর ক্যামেরা। আসলে সুব্রত মিত্র তো ছবি তোলার আগে সেতার বাজাতেন। 'দ্য রিভার' চলচ্চিত্রে জঁ রনোয়া তাঁকে দিয়ে টাইটেল মিউজিক করেন। 'পথের পাঁচালী' চলচ্চিত্রে সেই বাঁকে করে মিঠাইওয়ালার চলে যাওয়ার অবিস্মরণীয় দৃশ্যতে যে সঙ্গীত– তা সুব্রত মিত্রেরই রচনা। পণ্ডিত রবিশঙ্কর সে সময় বিদেশে থাকায় সত্যজিৎ রায়কে এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।

সুব্রত মিত্রের জীবন শুরু হয়েছিল অন্য ছন্দে। জন্মেছিলেন মিশ্র ঘরানার একটি বাঙালি পরিবারে– যেখানে রক্ষণশীলতা আর বিলেতি শিক্ষার সহাবস্থান। মাতুলালয় ছিল 'জলসাঘর' চলচ্চিত্রের জমিদারবাড়ির মতো থাম আর খিলানের। তাঁর দাদু কিছুদিন আঁকা শিখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের কাছে। বালক সুব্রত সে বাড়ির আলো-আঁধারি নিজের স্মৃতির সঞ্চয় করে রেখেছিলেন নিশ্চয়। অন্যদিকে ঠাকুরদাদা ছিলেন বিলেত-ফেরত ডাক্তার। ১৮৮৬-৮৭ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাওয়া তার সোনার মেডেল থেকে গেছে নাতির জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার’। রবিবার সকালে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে কখনও সাইকেলে চেপে চলে যেতেন কাছের সিনেমা-হলের সকালবেলার শো’তে। ভবিষ্যতে যার সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতায় সুব্রত বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠবেন, সেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এই বিষয়ে তাঁর অবিশ্বাস্য মিল।

বাংলা চলচ্চিত্রকে পরিণত এবং আন্তর্জাতিক করে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃৎ সুব্রত মিত্র ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহকের জাতীয় পুরস্কার এবং ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসাবে কোডাক পুরস্কার লাভ করেন। শেষজীবনে তিনি সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের সিনেমাটোগ্রাফির অধ্যাপক ছিলেন। মহান এই শিল্পী ২০০১ সালের ৯ ডিসেম্বর ইহলোক ছেড়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত