আজ কিশোরগঞ্জ মুক্ত দিবস

প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৫৯

সাহস ডেস্ক

৭১’ এর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে যখন বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করছিল ঠিক সেই সময়ও কিশোরগঞ্জবাসী যুদ্ধ করেছে পাক-হানাদারের শিকল ভাঙতে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, কিশোরগঞ্জে ১৬ ডিসেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত পাক বাহিনীর দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে, রক্ত ঝরেছে। অবশেষে শহরের চারদিক থেকে চতুর্মুখী আক্রমণ করে ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮টা দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনী হানাদারদের হটিয়ে মুক্ত করে কিশোরগঞ্জকে।

পাক হানাদার বাহিনী কিশোরগঞ্জে প্রথম আসে ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল এবং ছেড়ে চলে যায় ৪ ডিসেম্বর। পাক দখলদার বাহিনীর দালাল আল মুজাহিদ, আল বদর, আল শামস ও রাজাকারদের দল ৪ ডিসেম্বর হতে ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭টা পর্যন্ত ১৩ দিন কিশোরগঞ্জকে পাকিস্তান বানিয়ে রাখার চেষ্টা করে। গোটা দেশ যখন স্বাধীনতা অর্জনের উল্লাসে আত্মহারা তখনও কিশোরগঞ্জ শহর, পাক হানাদার বাহিনীর দোসরদের কঠোর নির্যাতনের শিকার।

বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্মভূমি এই কিশোরগঞ্জ, বীর প্রতীক সেতারা বেগম, বীর প্রতীক কর্ণেল হায়দার, বীর প্রতীক নূরুল ইসলাম খান পাঠানের বাড়ি এই কিশোরগঞ্জে, এ অঞ্চলের মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গর্ব করে।

বিপরীত দিকে নেজামে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাওলানা মুছলেহ উদ্দিন, নেজামে ইসলামের নেতা মাওলানা আতাহার আলী, হাবিবুল ইসলাম ভূঞা, আলমগীর শাহজাহান রেজাসহ অসংখ্য রাজাকার, আলবদরও জন্মেছিল এই কিশোরগঞ্জে, তাদের প্রতি রয়েছে মানুষের ঘৃনা।

মার্চের ক্রাকডাউনের পর সর্বপ্রথম ১৯ এপ্রিল শুক্রবার ট্রেনযোগে হানাদার পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জে আসে। ভৈরব থেকে কিশোরগঞ্জ শহরে ঢুকতে ট্রেন থামিয়ে থামিয়ে পাকবাহিনী আশপাশের গ্রামে বাড়িঘর আগুন জ্বালিয়ে আসতে থাকে। তাদের আগমনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে লোকজন পালাতে শুরু করে। রেলস্টেশনের পূর্ব পাশে সিগন্যাল পয়েন্টের কাছে তারাপাশা (বেন্দের বাড়ি) গ্রামের রুস্তম মিয়ার রিকশাচালক ছেলে জজ মিয়া প্রাণ ভয়ে পালাবার সময় হঠাৎ হানাদার বাহিনীর সামনে পড়ে যায়। সেখানেই পাক সেনারা গুলি করে তাকে হত্যা করে। জজ মিয়াই কিশোরগঞ্জের প্রথম শহীদ।

এরপর পাকবাহিনী রেলস্টেশন থেকে মূল শহরের দিকে এগিয়ে আসার পথে একরামপুর ব্রিজের ওপর পেয়ে যায় জাহাঙ্গীর মামু নামক শহরের অতি পরিচিত সাধুবেশী এক পাগলকে। পাক বাহিনীকে দেখে জাহাঙ্গীর মামু নামক পাগলাবেশী সাধু ‘জয় বাংলা’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হানাদার পাকবাহিনীর হাতের রাইফেল তুমুল আক্রোশে গর্জে ওঠে। একরামপুর ব্রিজের পাশেই পড়ে থাকে জাহাঙ্গীর মামুর নিস্প্রাণ দেহ।

কিশোরগঞ্জ শহরের ২য় শহীদ এই জাহাঙ্গীর মামুর কথা কিশোরগঞ্জবাসী আজও ভুলতে পারেনি। পুরানথানায় পান দোকানদার বীরেন্দ্র চন্দ্র সরকার (বীরু), খরমপট্টি এলাকার যতীন্দ্র পাল, কালাচাঁদ সরকারের স্ত্রী জ্ঞানদা সুন্দরী সরকার, তার ছেলে দুলু সরকার, রমেশ চন্দ্র দে, গুরুদয়াল সরকারি কলেজের পিয়ন আবদুল খালেক ভূইয়া, মো. আবদুল মালেক প্রমুখ।

সাড়া শহরজুড়ে এতোগুলো মানুষকে হত্যা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তারা। রেলস্টেশান সংলগ্ন ডাক বাংলায় তারা ক্যাম্প স্থাপন করে। নিরীহ নর-নারীকে ধরে নিয়ে সেখানে হত্যা ও ধর্ষণ করে। কিশোরগঞ্জের মানুষের কাছে এই ডাক বাংলা এখনো যেন এক অভিশাপময় আতঙ্কপুরী।

প্রতিদিনই চলছে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নি সংযোগ। ২৮ আগষ্ট খরমপট্টি এলাকার নিরীহ পরিবারের কর্তা খগেন্দ্র লৌহ ও তার বড় ছেলে কাজল লৌহসহ প্রায় সতেরজনকে ধরে নিয়ে যায় দালাল ও রাজাকাররা। ডাক বাংলায় দিনরাত নির্যাতন চালিয়ে পরদিন ২৯ আগস্ট কিশোরগঞ্জ থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে কালীগঞ্জ ব্রিজের ওপর দাঁড় করিলে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয় তাদের। সেখানে থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান কাজল লৌহ। শহীদ খগেন্দ্র কিশোর লৌহের অশীতিপর বৃদ্ধা স্ত্রী ছবি রানী লৌহ সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে চিহ্নিত এদেশীয় ঘাতকদের বিচার দাবি করেন।

শহর থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ি যশোদল ইউনিয়নে। আর এই জন্যই হয়তো ঘাতকের দল ওই এলাকার মানুষকে বিশেষ টার্গেট করে। ১৩ অক্টোবর স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে (তাদের রক্ষা করবে বলে) আশপাশের গ্রাম থেকে প্রায় ছয় শতাধিক মানুষকে একসঙ্গে আলোচনার কথা বলে বড়ইতলায় জড়ো করে এবং গুলিবর্ষণ ও বেয়নেট চার্জ করে খুন করে তিনশত পয়ষট্টি, (৩৬৫) জন নিরীহ মানুষকে। সেখান থেকে কোন রকমে বেঁচে যাওয়া সেদিনের কিশোর সিরাজুল ইসলাম মানিক সেই ঘটনায় তার বাবাসহ অনেক আত্মীয়স্বজন হারানোর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন।

দেশ স্বাধীন হবার পর এই বড়ইতলা নামকরণ করা হয় শহীদ নগর। স্বাধীনতার পর শহীদের স্মরণে এখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম একটি স্মৃতিস্তম্ভ করেন। সিদ্বেশরী, মনিপুরী ঘাট, শোলমারা পুল, শোলাকিয়া, বত্রিশ, বড়পুল, ভাস্করখিলাসহ একাধিক জায়গায় অগনিত নর-নারীকে হত্যা করে।

সাহস২৪.কম/মশিউর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত