গণহত্যার প্রথম প্রহর

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০১৭, ১৬:০৯

সাহস ডেস্ক

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে গণহত্যার প্রথম প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্বর পাকবাহিনী নির্মমভাবে ২০ শিক্ষকসহ দুই শতাধিক ছাত্র-কর্মচারীকে হত্যা করেছিল।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বর্বর পাকবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই নির্মম গণহত্যার স্মৃতি ও বেদনার ঘটনা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় গোটা দেশবাসীকে উত্তাল পঁচিশে মার্চের এই দিনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে এ তথ্য জানা যায়।

এতে বলা হয়, অপারেশন সার্চলাইট নামে ২৫ মার্চ ১৯৭১ -এর গণহত্যার রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তায় নেমে প্রথমে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ, ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং কিছু সহযোগী ব্যাটেলিয়ান। এই বাহিনীগুলোর অস্ত্রসম্ভারের মাঝে ছিলো ট্যাংক, স্বয়ংক্রীয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারী মর্টার, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি। এ সব সমস্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্থানী বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ইউনিট নং ৪১ পূর্ব দিক থেকে, ইউনিট নং ৮৮ দক্ষিণ দিক থেকে এবং ইউনিট নং ২৬ উত্তর দিকে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলেছিল।

অধ্যাপক আনোয়ার পাশার উপন্যাস ‘রাইফেল, রোটি, অওরাত’ থেকে জানা যায়, ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে অধ্যাপক ফজলুর রহমান এবং তার দুই আত্মীয় নীলক্ষেতের ২৩ নং ভবনে নিহত হন। তাঁর স্ত্রী দেশের বাইরে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। পাকবাহিনী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা এবং অধ্যাপক রশিদুল হাসানের (ইংরেজি বিভাগ) বাসভবন আক্রমণ করেছিল। তাঁরা দুজনেই খাটের নিচে লুকিয়ে বেঁচে যান । কিন্তু পরবর্তীতে আল-বদর বাহিনীর হাতে তারা প্রাণ হারান। ২৪ নং ভবনে বাংলা সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম থাকতেন। তাঁর বাসভবনে প্রবেশমুখে দুইজন আহত নারী তাদের সস্তানসহ কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের রক্তের দাগ লেগে ছিলো মাটিতে। পাকবাহিনী যখন তাঁর বাসভবন আক্রমণের জন্য আসে, তখন তারা রক্তের দাগ দেখে ধারণা করে নেয় অন্য কোন ইউনিট হয়তো এখানে হত্যাযজ্ঞ কাজ সমাধা করে গেছে। তাই তারা আর প্রবেশ করেনি। এভাবে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নিতান্ত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তীকালে তিনি জানান যে, ওই ভবনে আরও একজন পূর্ব-পাকিস্তানী অধ্যাপক বাস করতেন, যিনি ২৫ মার্চের আগেই ঘর ছেড়ে যান। অন্যসব বাসায় অবাঙালি কিছু পরিবার থাকতো, যারা অন্যদের কিছু না জানিয়েই ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যায়।

১২ নং ফুলার রোডের বাসভবনে পাকিস্তানী আর্মি সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সায়েদ আলী নোকির বাসায় যায়। পাক সেনারা তাকে ছেড়ে দিলেও ওই একই ভবনের ভূ-তত্ত্ববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মুক্তাদিরকে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহ জহরুল হক হলে (তদানীন্তন ইকবাল হল) পাওয় যায়। পরে তাঁর আত্মীয়রা তাঁকে পল্টনে সমাহিত করেন। ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক মুনিম, যিনি সেই সময় সলিমুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের দায়িত্বে ছিলেন। পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণে তিনি আহত হন।

তখন ঢাকা হলের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আ র খান খাদিম ও শরাফত আলীকে হত্যা করা হয়। পাক বাহিনী জগন্নাথ হলে শিক্ষকনিবাস আক্রমণ করে এবং অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মির্জা হুদা ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবিরকে লাঞ্ছিত করেছিল।

তৎকালীন সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের আবাস জগন্নাথ হল আক্রমণের সময় হলের প্রভোস্টের বাসাও আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তানী বাহিনী ভূতপূর্ব-প্রভোস্ট এবং জনপ্রিয় শিক্ষক, দর্শণ শাস্ত্রের অধ্যাপক জি সি দেবকে হত্যা করে। তার সংগে তাঁর মুসলিম দত্তক কন্যার স্বামীকেও। এর পর পাকিস্তানী বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী বাসভবনে আক্রমণ করে এবং সেখানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড মনিরুজ্জামানকে তাঁর পুত্র ও আত্মীয়সহ হত্যা করে। জগন্নাথ হলে প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা অধ্যাপক ঠাকুরতাকে চিনতে পারেন। কলেজের মর্গের কাছে একটি গাছের নিচে তাক সমাহিত করা হয়। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার সাথে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকেও হত্যা করা হয়েছিল। সহযোগী হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকেও ছাত্রাবাসেই হত্যা করা হয়। অধ্যাপক পাশা পরবর্তীতে ডিসেম্বর মাসে আল-বদর বাহিনীর হাতে নিহত হন বলে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. অজয় রায় বাসসকে জানান। 

অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মৌলবাদীদের হামলায় নিহত বিজ্ঞান লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের বাবা ড. অজয় রায় ১৯৭১ সালের কাল রাতের ঘটনার স্মৃতি চারণ করে আরো বলেন, অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের "স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদকে কেন্দ্র করে। তাই, পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিলো এই হলটি। অধ্যাপক ড. মুনিমের মতে, এই হলের কম-বেশি ২০০ জন ছাত্রকে পাকবাহিনী হত্যা করেছিল।

ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের তৎকালীন ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক ও বর্তমান এমিরিটার্স অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে বসে দেশের রাজনৈতিক সর্বশেষ পরিসস্থিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্বাবে বসে আলোচনা করছিলাম। ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দেয়া হয়েছিল। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৭১ সালের কাল রাতের ঘটনা স্মৃতি চারণ করে বাসসকে বলেন, রাত বারোটার পর পাকসেনারা জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে এবং প্রথমে মর্টার আক্রমণ চালায়, সেই সাথে চলতে থাকে অবিরাম গুলি। তারা উত্তর ও দক্ষিণের গেট দিয়ে ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। সেই আঘাতে ৩৪ জন ছাত্র প্রাণ হারান। জগন্নাথ হলের কয়েকজন ছাত্র রমনা কালী বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন। সেখানে ৫/৬ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে কেবলমাত্র একজনের নাম পরবর্তীতে জানতে পারা যায়, তার নাম রমণীমোহন ভট্টাচার্য্য। ছাত্রদের কাছে আসা অনেক অতিথিও এই সময় প্রাণ হারান। এদের মধ্যে ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পল, জগন্নাথ হলের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর। আর্চার কে বল্লার্ড-এর বই " দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ” হতে জানা যায় যে, ছাত্রীনিবাস রোকেয়া হলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ছাত্রীরা আগুন থেকে বাঁচতে হলের বাইরে আসা শুরু করলে পাকবাহিনী তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায়। পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে আর্মি ইউনিট ৮৮ এর কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ জন ছাত্রীকে সে সময় হত্যা করা হয়।

সেই সময় কর্মকর্তা-কর্মচারী হত্যা করা হয়েছিল যেভাবে : জহরুল হক হল আক্রমণের প্রথম র্পর্যায়েই ব্রিটিশ কাউন্সিলে পাহারারত ইপিআর গার্ডদের হত্যা করা হয়। তারপর হলের কর্মচারী সিরাজুল হক, আলী হোসেন, সোহরাব আলী গাজী ও আব্দুল মজিদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাউঞ্জে হত্যা করা হয়। রোকেয়া হল চত্বরে সপরিবারে হত্যা করা হয় আহমেদ আলী, আব্দুল খালেক, নমি, মোঃ সোলায়মান খান, মোঃ নুরুল ইসলাম, মোঃ হাফিজুদ্দিন ও মোঃ চুন্নু মিয়াকে।

শহীদ মিনার ও বাংলা একাডেমি আক্রমণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাদলটি শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন শিক্ষক নিবাসগুলোয় এবং মধুসূদন দে'র বাসভবনেও আক্রমণ করে। ১১ নং ভবনে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ সাদেককে হত্যা করা হয়। এখানে পাকবাহিনী প্রায় ৫০টির মতো হত্যাকান্ড ঘটায়, যাদের মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজন পুলিশ অফিসারও ছিল। মার্চের ২৫ থেকে ২৭ তারিখের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভিন্ন ধর্মালম্বীদের তিনটি উপাসনালয় ধ্বংস করেছিল । এরমধ্যে কলা ভবন সংলগ্ন গুরুদুয়ারা নানক শাহী, রমনা কালী মন্দির ও শহীদ মিনার সংলগ্ন রমনা শিব মন্দির। রাতে দর্শণ বিভাগের কর্মচারী খগেন দে, তার ছেলে মতিলাল দে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী সুশীল চন্দ্র দে, বোধিরাম, ডাক্কুরাম, ভিমরায়, মণিরাম, জহরলাল রাজবর, মনবরণ রায়, রাজবর ও সংকর কুরীকে হত্যা করেছিল বর্বর পাক হানাদার বাহিনী ।

ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জানান, ১৯৭১ এ যুদ্ধকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ খালি ছিল। মার্চের গোড়ার দিকে তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাইয়িদ চৌধুরী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে জেনেভায় অবস্থান করছিলেন। তিনি পত্রিকা মারফত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রাদেশিক শিক্ষাসচিবের কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। পরে তিনি জেনেভা থেকে লন্ডনে যান ও সেখানে থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের জন্য কাজ করেন। পরে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক আরো জানান, ২০জন শিক্ষক, ১২ কর্মচারী ও অসংখ্য ছাত্রকে পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। 

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আল-বদর সদস্যরা মাঠে নামে। তারা তালিকা অনুসারে বাঙালি অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং আরো অনেক মেধাবী বুদ্ধিজীবিদের বেছে বেছে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বলেন, যারা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল তাদের বিচার হচ্ছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম অবিলম্বে সম্পন্ন করতে হবে। আজ একাত্তুরের পরাজিত শক্তি আইএসআই ও আইস এস -এর সহায়তায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংষ করার গভীর চক্রান্ত শুরু করেছে। আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছে। যা পাকিস্তানী বর্বরবাহিনী ১৯৭১ সালে করেছিল আজ দেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের দাবির নামে সেই একই কায়দায় যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে শিশু ও নারীসহ সাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করছে। তারা মুলত: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত ও ধ্বংষ করতে চায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত