বছরজুড়েই রক্তাক্ত ছিল রাজশাহী

প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:১৬

একের পর এক খুন-খারাবিতে ২০১৬ সালে রাজশাহী ছিল রক্তাক্ত। গত বছর রাজশাহীতে সংগঠিত কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সারাদেশে চাঞ্চল্যর সৃষ্টি করেছিল। এর মধ্যে কয়েকটি হত্যার ক্লু বের হয়েছে। তবে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডের কারণ এখনও সবার কাছে অজানা। এরপরেও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবগুলো হত্যাকাণ্ডের ক্লু উৎঘাটন করে তারা জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে রাজশাহীতে প্রায় ৬০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। লেডিস অর্গানাইজেশন ফর সোসিয়াল ওয়েলফেয়ারের দেওয়া তথ্যমতে, শুধু ২০১৬ সালেই রাজশাহীতে ৩৪ নারী ও শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এছাড়া অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে আরও ৫১ শিশু ও ৩৬ নারীর। 

গত বছর রাজশাহীতে যেসব খুনের ঘটনা ঘটে তার মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যর সৃষ্টি করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা। এছাড়া আলোচনায় আসে পীরের মুরিদ পবার শহীদুল্লাহকে গলাকেটে হত্যা ও ব্যবসায়ী জিয়াউল হক টুকুকে গুলি করে হত্যার ঘটনা। একের পর এক এসব হত্যাকাণ্ডে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন রাজশাহীবাসী।

গত ২৩ এপ্রিল সকালে দুর্বৃত্তরা অধ্যাপক রেজাউল করিমকে নগরীর শালবাগান এলাকায় তার বাড়ির মাত্র ১০০ গজ দূরে একটি গলির ভেতর কুপিয়ে হত্যা করে। জঙ্গি সংগঠন এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে পুলিশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। এ হত্যার ঘটনায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান পায় অধ্যাপক সিদ্দিকী হত্যার খবর। আর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আন্দোলনে প্রায় অচল হয়ে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এ খুনের সঙ্গে জড়িত দুই জন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। আর মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে আদালতে।

বছরের শেষ সময়ে গত ১৯ অক্টোবর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন মোতালেব হোসেন লিপু (২৩) নামে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। এ হত্যার কারণ এখনও উৎঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। গত ২২ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীর হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল থেকে তরুণ-তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হোটেল কক্ষে প্রেমিকা সুমাইয়া নাসরিনকে হত্যার পর প্রেমিক মিজানুর রহমান আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও ঘটনাটি নিয়ে এখনও ধূম্রজাল রয়েছে।

এদিকে গত ২৪ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীর নগর ভবনের সামনে নিজ চেম্বারে গুলি করে হত্যা করা হয় রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক জিয়াউল হক টুকুকে। টুকুকে তার কয়েকজন বন্ধু পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন বলে দাবি করছেন তার পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গত ৮ ডিসেম্বর রাজশাহী মহানগরীর চণ্ডিপুর এলাকায় এ্যানি খাতুন (১১) নামে এক মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ৬ জুন রাজশাহীর তানোর উপজেলা থেকে শহীদুল্লাহ (৬০) নামে এক ব্যক্তির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার মহানন্দখালি এলাকায়। শহীদুল্লাহ পীরের ভক্ত ছিলেন। জঙ্গি সংগঠন তাকে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হলেও পুলিশ এখনও বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি। কাউকে গ্রেপ্তারও করতে পারেনি এ ঘটনায়।

গত ১৯ মে ব্যাটারিচালিত একটি ভ্যানের জন্য রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে তানোরের এক কিশোরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরে গোদাগাড়ী থানা পুলিশ ওই কিশোরের লাশ উদ্ধার করে। এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি জেলার পুঠিয়া উপজেলার গোপালহাটি গ্রামে মালেকা বেগম (৫০) নামের এক নারীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় তার সাবেক স্বামী শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত ৭ মে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাগমারার হাটগাঙ্গোপাড়ায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এ ঘটনায় মোট চার জনের মৃত্যু হয়।

এদিকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি চারঘাট উপজেলার পিরোজপুর এলাকায় পদ্মা নদীর চর থেকে হাত-পা বাধা অবস্থায় আকবর আলী (৪৫) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারী তানোরে আরশাদ আলী বিজন (৪৭) নামের এক দিনমজুরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাকেও খুন করা হয়। ১ মার্চ বাগমারার পরিত্যাক্ত এক ইটভাটার হাউজ থেকে পুলিশ আনোয়ার হোসেন (৬২) নামের এক মুদি দোকানির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। আনোয়ার হোসেনকে অপহরণ করা হয়েছিলো।

এ ঘটনার পর দিনই বাগমারায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে দুলাল হোসেন (২৬) নামে এক যুবক মারা যায়। ১৮ মার্চ পুঠিয়া উপজেলার গোন্ডগোয়ালি গ্রামে নজরুল ইসলাম (৬৫) নামে এক বৃদ্ধকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ৩০ মার্চ দুর্গাপুরের পনানগর গ্রামের একটি ব্রীজের নিচ থেকে নাসির হোসেন (৩০) নামে এক যুবকের জবাই করা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এদিকে গত ১৭ এপ্রিল প্রকাশ্যে রাজশাহী মহানগরীতে স্ত্রীকে জবাই করে হত্যার ঘটনা ঘটে। নগরীর শাহ মখদুম থানার বায়া ভোলাবাড়ি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় স্বামীকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয়রা। এদিকে ভাগ্নিকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় ২৮ এপ্রিল রাজশাহীর পবা উপজেলার শিতলাইয়ে আবুল কালাম (৫০) নামে ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করে বখাটেরা।

১৭ মে তানোর উপজেলার শিলিমপুর গ্রাম থেকে মুক্তার হোসেন (৩০) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের ঘাড়ে ও পিঠে কোপানোর চিহ্ন ছিলো। ৩১ মে দুর্গাপুরের ধরমপুর গ্রামে মুরগি মারাকে কেন্দ্র করে অফিয়া বেগম (৬০) নামে এক বৃদ্ধাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২৫ নভেম্বর তানোরে শহিদুল ইসলাম (৩৫) নামে এক দিনমজুরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। ২৭ নভেম্বর বাগমারায় খুরশেদ আলম (৪২) নামে কৃষককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৯ নভেম্বর দুপুরে রাজশাহী মহানগরীর বুলনপুর এলাকায় প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাত করে রাসেল আলী (১৯) নামে এক বীমাকর্মীকে হত্যা করা হয়।

গত ৩ ডিসেম্বর গোদাগাড়ী উপজেলার সাতপুকুরিয়া জোতগোপাল গ্রামে ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই খুন হন। বাড়ির সীমানা ভাগকে কেন্দ্র করে খাইরুল ইসলাম (৪২) নামে ওই ব্যক্তি খুন হন। এর আগে ১৬ নভেম্বর রাজশাহী নগরীর ফায়ার সার্ভিস মোড় এলাকায় নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ঠিকাদার খন্দকার মাইনুল ইসলাম নিহত হন। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মাইনুল ইসলাম নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে।

এদিকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর নগরীর বুধপাড়া এলাকায় শাহরিয়ার আলম কাব্য নামে সাত বছরের এক শিশু সন্তানকে কুপিয়ে হত্যার পর নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তার মা। এই ঘটনায় মা তসলিমা বেগমকে (৩০) পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ঘটনার পর তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেছেন।

অন্যদিকে গত ৩১ অক্টোবর রাতে রাজশাহী নগরীর জামালপুর তাতপাড়া এলাকায় ছুরিকাঘাতে লালা মিয়া (১৭) নামে এক কিশোরকে খুন করে তার বন্ধুরা। এ ঘটনায় লালার তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তারও করা হয়। ১৪ জুন মহানগরীর চণ্ডিপুর এলাকায় আহসান হাবিব আপেল (২৬) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বর পুঠিয়া উপজেলার সাধনপুর গ্রামে আমজাদ হোসেন (৩৫) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এমনই রক্তাক্ত ছিল ২০১৬ সাল।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম ও রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) মোয়াজ্জেম হোসেন ভুঁইয়া জানিয়েছেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছেন। বেশ কিছু হত্যার কারণ উৎঘাটন হয়েছে। অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন এসব মামলায়। আদালতে বিচারও শুরু হয়েছে বেশ কিছু হত্যা মামলার।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত